জীবনী: নীলস বোর

জীবনী: নীলস বোর নীলস হেনরিক ডেভিড বোর হলেন বিংশ শতাব্দীর সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের অন্যতম। তিনিই প্রথম কোয়ান্টাম থিওরিকে পরমাণুর গঠন কাঠামোর সমস্যা সমাধানে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে তিনি গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে সারা বিশ্বের পরমাণু বিজ্ঞানীদের পদ প্রদর্শক হিসাবেও কাজ করেছেন।

নীলস বোরের জন্ম হয়েছিল ১৮৮৫ সালে ৭ই অক্টোবর কোপেনহেগেনে। তার পিতা ক্রিশ্চিয়ান বোর ছিলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মা এলেন এডলার বোর ছিলেন ডেনমার্কের জৈনক ব্যাংকারের কন্যা। বাল্যকাল থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল নীলসের।

বাবা-মা ও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। তাই তারাও ছেলের মন বুঝে যেদিকে তার আগ্রহ সেদিকেই উৎসাহ দিচ্ছিলেন। ছেলেকে বেড়ে উঠতে দিচ্ছিলেন তার নিজের মতো করে। বাল্যকাল থেকেই নীলস ছিলেন অসম্ভব রকমের মেধাবী। তার যখন মাত্র ২২ বছর বয়স, কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তিনি ডেনমার্কের রয়্যাল একাডেমী অব সাইন্সের স্বর্ণপদক লাভ করেন।

তিনি জলের উপরিভাগের টানের উপর গবেষণা প্রবন্ধ লিখে এই পদক পেয়েছিলেন। ১৯১১ সালে নীলস বোর পদার্থের ইলেকট্রন থিওরির ওপর প্রবন্ধ লিখে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জে. জে. থমসনের অধীনে গবেষণা করার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড গমন করেন।

কিন্তু সেখানে তার বেশিদিন থাকা হয়নি। বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রেদারফোর্ডের সাথে যৌথভাবে পরমাণুর গঠনকাঠামোর উপর গবেষণা করার জন্য অচিরেই তিনি ম্যানচেস্টার গমন করেন। তার প্রথম সাফল্যজনক গবেষণা হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস মডেলের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করা। রেদারফোর্ডের অনুরোধ ও তত্ত্বাবধানে তিনি এই গবেষণা করেছিলেন।

নীলস বোরই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি পদার্থের প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক চরিত্র বিশ্লেষণের পারমাণিক সংখ্যার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হন। ১৯১৩ সালে তিনি ম্যাক্সপ্লাংকের কোয়ান্টাম থিওরি এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা দ্যুতি সংখ্যাতত্ত্বকে একত্রে সমন্বয় সাধন করে নিউক্লিয়ার এটমের সাথে।

এটি ছিলো একটি বড় এবং জটিল কাজ। কাজটি করতে গিয়ে তাকে উচ্চতর পদার্থ থেকে মৌলিক পদার্থকে আলাদা করতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, প্রত্যেকটি পরমাণু একটি পৃথক ও স্থায়ী শক্তির অবস্থায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে।

পরমাণু দ্যুতি তখনি উজ্জ্বল হয় যখন একটি অবস্থা থেকে অন্য একটি অবস্থায় স্থানান্তরিত হবার মুহূর্তে আসে। বিকিরণের ফ্রিকোয়েন্সি নির্ভর করে এর প্রাথমিক ও চূড়ান্ত অবস্থায় তারতম্যের উপর। এর অর্থ হলো পরমাণু কখনো নিরিবিচ্ছিন্নভাবে শক্তিকে আত্মীয়করণও করে না, তেমনি ছড়িয়েও দেয় না।

কিন্তু এই কাজটি সে করে একটি সীমাবদ্ধ অবস্থায় অথবা কোয়ান্টাম লম্ফ দেওয়ার সময়। নীলস বোর যখন এমন একটি জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত তখনি ১৯২২ সালে মারগ্রেট নরলান্ড নামে জৈনক বিদুষী মহিলাকে বিয়ে করেন। কিছু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও তিনি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ম্যানচেস্টারেই ছিলেন।

তারপর প্রফেসর হয়ে ফিরে আসেন কোপেনহেগেনে। এখানে এসে চার বছর পর ১৯২০ সালে কোপেনহেগেন থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স ইন্সটিটিউটের পরিচালক মনোনীত হন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন, যদিও মাঝখানে কিছুদিনের জন্য তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়েছিল।



১৯২০ সালে নীলস বোর তার পরমাণু গঠন সম্পর্কিত গবেষণাকে আরো বিস্তৃত করেন। তিনি বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুর সংখ্যার তালিকা প্রণয়ন করেন। এই গবেষণার জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পারমাণিক গঠনের ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি ১৯২২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

পরবর্তী সময়ে ১৯২৫-২৬ সালের পরমাণুর গঠনকাঠামো ও প্রকৃতি নিয়ে আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী গবেষণা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন ওয়ার্নার হেইসেনবার্গ এরুইন স্কোডিংগার, ম্যাক্স বোর্ন, ওলফগ্যাং পোলি, পল ডিরাক এবং আরো অনেকে। কিন্তু তা হলেও কোপেনহেগেনের নীলস বোর ছিলেন পরমাণু গবেষণাযর শীর্ষবিন্দুতে।

নিলস বোরকে কেন্দ্র করে কোপেনহেগেন ছিল তখন পরমাণু বিজ্ঞান গবেষণার এক তীর্থ কেন্দ্র। পৃথিবীর প্রায় সব পারমাণু বিজ্ঞানীরই আগ্রহ ছিল কোপেনহেগেন এগিয়ে নীলস বোরের অধীনে পরমাণুর উপর গবেষণা করা অথবা তার সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করা। তিনি ছিলেন যেন পরমাণুর গবেষণার এক মূর্ত প্রতীক।

পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা এবং পরামর্শে আরো একটি জিনিস এ বের হয়ে এলো, তা হল প্রকৃতির গাণিতিক বর্ণনার ক্ষেত্রে পদার্থগত ব্যাখ্যা। কোপেনহেগেনের এই ব্যাখ্যা পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীই মেনে নিলেন, কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন শুধু এর বিরোধিতা করতে লাগলেন।

যদিও তিনি এবং নীলস বোর বহুবার নিজেদের মধ্যে পদার্থের মৌলিক প্রশ্নবলী নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু মীমাংসায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি কেউ। আইনস্টাইনের এই বিরোধিতা তাই বোরস মতবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে ছিল একটি বড় রকমের বাধা।

১৯৩০ সালেও তিনি কোয়ান্টাম থিওরির কিছু সমস্যার উপর কাজ করেন এবং এ ছাড়াও তিনি পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার নতুন ক্ষেত্রের উপর গবেষণা করেন। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত তার ধারণাযই পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বিভাজনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

১৯৪০ সালে জার্মানি দখল করে নেয় ডেনমার্ক। তখন তিনি তার ইনস্টিটিউশনে বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বাইরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ডেনমার্কের শিল্পসংস্কৃতি ছিল জার্মান সংস্কৃতি থেকে আলাদা।

যখন দখলদার জার্মানরা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো সর্বত্র, তখন আত্মভোলা বিজ্ঞানীর চমক ভাঙলো। তার ভয় হলো হয়তো দখলদার জার্মান নাজি শক্তি তারও শান্তি ভঙ্গ করতে ছাড়বে না। বিশেষ করে নীলস বোরের মা ছিলেন ইহুদি ঘরের মেয়ে। তাই জার্মানদের ইহুদি বিদ্বেষের কারণে তিনিও হয়তো ওদের নজরে পড়ে যেতে পারেন। গ্রেফতারও হতে পারেন।

তাই তিনি আত্মরক্ষার জন্য ১৯৪৩ সালে ডেনমার্ক ছেড়ে পালাবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি একদিন রাতের অন্ধকারে পরিবার পরিজন নিয়ে ডেনমার্কের স্বদেশী আন্দোলনরত গেরিলাদের সহায়তায় একটি মাছ ধরার নৌকোয় করে দেশ ছেড়ে পালালেন। এই পালানোর সময় তার সাথে ছিলেন তার সুযোগ্য পুত্র এবং বিশিষ্ট তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ এয়াগা। তারা প্রথমে এসে পৌঁছলেন ইংল্যান্ডে।

ব্রিটিশ সরকারও এই বিজ্ঞানী কে সাদরে গ্রহণ করলে। নীলস বোর এখানে এসে হাত দিলেন পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজে। এরপর তিনি গেলেন নিউমেক্সিকোর লজ আলামোজে। তিনি পার্মানিক বোমা তৈরীর ব্যাপারে সহযোগিতা করলেন যুদ্ধের প্রয়োজনে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ)। যুদ্ধজয়ের জন্য পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন এটা তারই মতামত ছিল।

তবে এই অস্ত্রকে অবশ্যই সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিও হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই ভয়াবহ অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে তা মানবসভ্যতার জন্য বিপদজনক হবে। তিনি এই বিষয়টি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজবেল্টকেও বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং তারা যখন পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আশ্বাস দিয়েছিলেন শুধু তখনি তিনি এই অস্ত্র তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন।

তারপর পারমাণবিক বোমা তৈরি হয় এবং হিরোশিমা নাগাসিকাতে তার বাস্তব ব্যবহারও হয়। এই ব্যবহারের পরেও তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কেমন করে এই মারাত্মক শক্তির সীমিত শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করা যায়।এর জন্য তিনি ১৯৫০ সালে জাতিসংঘে সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে ব্যক্তিগতভাবেও পত্রে আবেদন জানিয়েছিলেন।

তিনি ১৯৫৫ সালে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও একই আবেদন জানিয়েছিলেন। তার এই শান্তির বাণীর জন্যই তিনি ১৯৫৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও হাসপাতালর শল্যচিকিৎসকরা একবাক্যে স্বীকার করতেন যে, একটি রোগীকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *