জীবনী: জুল ভার্ন

জীবনী: জুল ভার্ন উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অর্ধশতাব্দী কাল পূর্বেই তিনি হেলিকপ্টারের কথা বলেছিলেন, রেডিও আবিষ্কারেরও বহু আগেই যে ব্যক্তি টেলিভিশনের কথা কল্পনা করেছিলেন, যেকালে মানুষ চাঁদে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতো না, তখনি যিনি চাঁদের বুকে বসতি স্থাপনের কথা বলে ফেলেছিলেন, তিনি নিজে ছিলেন এক ঘরকুনো মানুষ।

কল্প বিজ্ঞানের উপর বিশ্বের সর্বপ্রথম রচিত ও সর্বাধিক সাড়া জাগানো গ্রন্থসমূহের লেখক জুল ভার্ণ। জুল ভার্ণের ছিলো আশ্চর্য কল্পনা শক্তি। যেসব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এখনো আবিষ্কার হয়নি, বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর পর্যন্ত যা সম্পর্কে তখনো কোনো কল্পনাই করতে পারেননি, তখনি তিনি সেসব বস্তুর কথা বলে গেছেন এবং এমন নিখুঁতভাবে বলে গেলেন যা পড়ে মনে হয়, হয়তো তিনি নিজেই সে সবের আবিষ্কারক এবং এ সম্পর্কে তার সকল বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে।

অথচ তিনি আদৌ কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। আর যেসব কল্পকাহিনীর তিনি বর্ণনা দিয়েছেন সে সম্পর্কেও তার কোনো বাস্তব ধারনা ছিলো না। অথচ তার কল্পকাহিনী সবগুলোই পরবর্তীকালে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে এবং আরো আশ্চর্য যে, তিনি যেভাবে কল্পনা করেছেন জিনিসগুলো হুবহু তেমনি ভাবেই রূপ লাভ করেছে।

পরবর্তী কালে যেসব বিজ্ঞানীরা এগুলো আবিষ্কার করেছেন, তারাও স্বীকার করেছেন যে তারা এই বস্তুটির আবিষ্কার সম্পর্কে জুলভার্ণের কল্পনা দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত বেতার আবিষ্কারক মার্কনী, সাবমেরিনের জনক সাইমন লেক, বেলুনিষ্ট এবং ডীপ সী আবিষ্কারক অগাষ্ট পিকার্ড এবং আরো অনেক বিজ্ঞানী শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেছেন যে, জুলভার্ণই তাদেরকে এসব আবিষ্কার করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।

এমনকি ফ্রান্সের বিখ্যাত মার্শাল লিয়াওটি বলেছেন– জুল ভার্ণ যা তার লেখার মাধ্যমে দেখিয়েছেন তাই পরবর্তীকালে পরিণত রূপে বাস্তবে বেরিয়ে এসেছে। জুল ভার্ণের নায়কেরা সাবমেরিন নিয়ে প্রবেশ করেছেন পাতালে, উড়ে গেছে আকাশ যানে চাঁদের বুকে, যাত্রা করেছেন কতো দুর্গম পথে। কিন্তু যিনি এসব দুসাহসিক অভিযানের কল্পনাকারী, তিনি সারা জীবনে কখনো ঘর থেকেই বের হননি।

এমনকি তিনি এতো ঘরকুনো ছিলেন যে, জীবনের চল্লিশটি বছরই কাটিয়েছেন বাড়ির একটি চিলে কোঠায়। এই আশ্চর্য মানুষ জুলভার্ণের জন্ম হয়েছিলো ১৮২৮ সালে ফ্রান্সের নানতেস নামক স্থানে। বাবা ছিলেন আইনজীবী। তাই তার ইচ্ছে ছিল তার ছেলেও আইন ব্যবসা করে দুপয়সা আয় করতে শিখুক, সুখে থাকবে।

কিন্তু জুলভার্ণের আইন পড়ার দিকে তেমন আগ্রহ ছিলো না। আইন পড়ার চেয়ে তিনি মনোযোগ বেশি দিতেন সাহিত্য চর্চার দিকে। এতে বাবা ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে অপদার্থ ছেলের মাসিক ভাতা দিলেন বন্ধ করে। অতঃপর জুলভার্ণ আর কি করেন?

পেট চালানোর জন্য এক থিয়েটারে কাজ জুটিয়ে নিলেন। পরে তিনি কাজ নিলেন এক কোম্পানীর কাগজের দালালীর। এতে অবশ্য তার বেশ আয় হতে লাগলো। একদিকে চলছিলো দালালী আর অপরদিকে লেখার কাজ। তিনি তখন থেকেই বাস করতেন এক নির্জন চিলে কোঠায়, সেখানেই চলতো তার লেখালেখির কাজ। সাহিত্য সাধনায় একান্ত নিমগ্ন থাকলেও ভাগ্য সহজে সুপ্রসন্ন হয়নে তার।



তার প্রথম গ্রন্থ বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ এর পাণ্ডলিপি নিয়ে শুরু হলো প্রকাশকের দুয়ারে ঘোরাঘুরি। কিন্তু কেউ তার এই উদ্ভট কাহিনী ছাপতে চাইলেন না। একে একে পনেরো জন প্রকাশক ফিরিয়ে দিলেন তার পাণ্ডলিপি। অতঃপর প্রচণ্ড অভিমানে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পাণ্ডলিপিটি পুড়িয়ে ফেলতে ছুড়ে দিলেন জ্বলন্ত আগুনে। কিন্তু রক্ষা করলেন তার স্ত্রী।

স্ত্রী স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – অন্ততঃ আরেকজন প্রকাশককে দেখাও। অবশেষে স্ত্রীর কথাই সত্যি হলো। বইটি ষোড়শতম প্রকাশক ছাপতে রাজী হলেন। কিন্তু বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই শুরু হলো অবিশ্বাস্য রকমের কাটতি। হলো বছরের বেষ্ট সেলার। শুরু হলো অন্যভাষায় অনুবাদ।

জুলভার্ণের সাহিত্য খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সবদিকে। এবার প্রকাশক নিজেই গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। আগ্রহ ভরে চুক্তি করলেন লেখকের সাথে। কথা হলো – জুল ভার্ণ অন্ততঃ প্রতিবছর দু’খানা করে পাণ্ডলিপি তাকে দিবেন। অতঃপর তাই হলো। তিনি নিজের পুরনো দালালীর ব্যবসা ছেড়ে শুরু করলেন একান্ত মনে সাহিত্য সাধনা। টাকাও আসতে লাগলো প্রচুর।

কেটে গেলো আর্থিক অনাটন। প্রকাশিত হলো তার দ্বিতীয় বই ’পাতাল অভিযান’ এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন একটি মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে প্রবেশ করে একদল মানুষ কেমন দুঃসাহসিক পাতাল অভিযান সম্পন্ন করেছিলেন। জুলভার্ণের হাতে তখন অনেক টাকা। তাই তিনি এবার চলে এলন প্যারিস থেকে অ্যামিয়েনে।

সেখানে এসে তৈরি করলেন সুন্দর এবং মজার ডিজাইনের একটি বাড়ি। প্রকাণ্ড এই বাড়িটিতে উপরে ছিলো একটি টাওয়ার। টাওয়ারটি দেখতেও অবিকল নাবিকদের কেবিনের মতো। আসলে এটাও ছিলো একটি চিলেকোঠা। যে চিলেকোঠায় তিনি আবদ্ধ থেকেছেন সারা জীবন। এটাও তাই। তার লেখার আর পড়ার ঘর। এখানেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন তার জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর।

জুল ভার্ণের জীবনের সবচােইতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই হলো, আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ এই বইটি যখন প্যারিসের লা টেম্পস পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে তখন প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। বইটির নায়ক বাজি ধরে সত্যি সত্যি ৮০ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে বহু পাঠক বাজিও ধরেছিলো।

জুল ভার্ণ পাঠকদের এই প্রচণ্ড আগ্রহও উত্তেজনা শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নায়ক হাজারো বিপদ অতিক্রম করে ৮০ দিনের মাত্র ৫ মিনিট থাকতে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে বাজি জিতে যায়। জুল ভার্ণের এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দান করার জন্য ১৮৭২ সালের নিউইয়র্কের নেলী বলাই নামে একজন সাংবাদিকও বিশ্বভ্রমণে বের হন।

তিনি জুল ভার্ণের রেকর্ড ভঙ্গ করে ৭২ দিনে পৃথিবী ঘুরে আসেন। এরপর একজন ফরাসী সংবাদদাতা ৪৩ দিনে ভূ-প্রদক্ষিণ করেন। জুল ভার্ণ তার সাগরতলে গ্রন্থে নটিলাস নামের যে সাবমেরিনটির কথা বলেছেন তা ছিলো বিদ্যুৎ শক্তি চালিত, যে বিদ্যুৎ সাগর তলদেশ থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করা হতো।

তারপর বাস্তবে ইউ, এস, নেভীর যে আনবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন তৈরি হয় তার নামও রাখা হয় নটিলাস। আসলে জুলভার্ণের কল্পনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই এই বাস্তবের নটিলাস তৈরি হয়েছিলো। জুল ভার্ণের শেষ জীবনটা খুব সুখের ছিলো না। কারণ বুদ্ধিজীবীরা তাকে অজ্ঞতা করতো।

অবশ্য এই অবজ্ঞা ছিলো হিংসা প্রসূত। কারণ জুলভার্ণ ছিলেন তার সময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক। এটা পণ্ডিতেরা সহ্য করতে পারতেন না। যার জন্য তিনি এতো বড় লেখক হওয়া সত্যেও ফ্রান্স একাডেমীর সদস্য মনোনীত হতে পারেননি। ১৯০৫ সালে এই বিশ্বের বিস্ময়কর পুরুষ জুলভার্ণের মৃত্যু হয়। আজো তার জন প্রিয়তা এতোটুকু হ্রাস পায় নি, আজো তিনি বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকগণের অন্যতম।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল জীবজগতের এটি একটি বিরাট বিস্ময়। মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড় এবং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *