জীবনী: এডমান্ড হ্যালি

জীবনী: এডমান্ড হ্যালি সৌজগতের গ্রহ উপগ্রহের সাথে আরো এক ধরনের জ্যোতিষ্ক আছে ধুমকেতু যার নাম। এরাও সূর্যকে ঘিরে নিজের নিজের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই ধুমকেতুদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বিখ্যাত, সেটি হল হ্যালির ধূমকেতু। এই হ্যালির ধুমকেতু প্রতি ৭৬ বছর পরপর একবার করে আকাশে উদিত হয়, অর্থাৎ একবার করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।

হ্যালির ধূমকেতু সর্বশেষ আকাশে উদিত হয়েছিল ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে। এই বিখ্যাত ধুমকেতুটি যিনি আবিষ্কার করেন, তিনি হলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালি। বিজ্ঞানী হ্যালি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন বলেই তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে হ্যালির ধূমকেতু। অর্থাৎ হ্যালি আবিষ্কৃত ধূমকেতু।

তার আরেকটি বড় কৃতিত্ব হল বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ Philosophiae Naturalis Principia Mathematice হ্যালির তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালির জন্ম হয় ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ৮ নভেম্বর তারিখে লন্ডনে। বাল্যশিক্ষা শুরু হয় লন্ডনের সেন্ট পল স্কুলে।

অ্যাডমন্ড হ্যালির যখন জন্ম হয়, সে সময়টা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের উন্মেষের যুগ। তার যখন সাত বছর বয়স তখন ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস এর রাজত্বকাল শুরু হয়। রাজা চার্লস দ্বিতীয়ের সিংহাসনে আরোহণের দুবছরের মধ্যে লন্ডনে স্থাপিত হয় একটি প্রকৃতিবিজ্ঞান গবেষণা কলেজ। কলেজটির নামকরণ করা হয় ‘অদৃশ্য কলেজ’।

এই অদৃশ্য কলেজই পরবর্তীকালে রয়েল সোসাইটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্কুলের পড়া শেষ করে হ্যালি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন অক্সফোর্ড কুইনস কলেজে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই কলেজে জতির্বিজ্ঞানী ছিলেন জন ফ্লেমস্টীড। ফ্রেমস্টীড সাহেব অত্যন্ত স্নেহ করতেন হ্যালিক। ফ্লেমস্টীড কাজ করতেন রয়্যাল গ্রীনিচ অবজারভেটরিতে।

এই পরিচয়ের সূত্র ধরে বাল্যকালেই হ্যালি বেশ কয়েকবার গ্রীনিচ অবজারভেটরিতে যাবার সুযোগ লাভ করেন। তখনই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর হাতে কলমে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। এই ছাত্র অবস্থায় হ্যালি তার শিক্ষক ফ্লেমস্টীডের তত্ত্বাবধানে উত্তর আকাশে নক্ষত্র গণনার উপর গবেষণা করতে থাকেন।

উত্তর আকাশের উপর গবেষণা করতে করতে তার নিজের উপর বিশ্বাস জন্মে যায়। তখন তিনি দক্ষিণ আকাশের নক্ষত্রের অবস্থান সমূহের উপর গবেষণা করার প্রস্তাব করেন। ফ্লেমস্টীড স্বয়ং প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। তাছাড়া তার সুযোগ্য ছাত্র হ্যালির উপরও ছিল তার অগাধ বিশ্বাস।

তিনি শুধু সমর্থন নয়, হ্যালি যাতে এই গবেষণা চালাতে পারেন তারও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। কর্তৃপক্ষের, অর্থাৎ রাজা চার্লস-এর অনুমোদন এবং যাবার আয়োজন তিনি নিজেই করেছিলেন। হ্যালি অতঃপর ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজে করে রওনা দিলেন দক্ষিণ গোলার্ধ।

উল্লেখ্য যে, তখনো অ্যাডমন্ড হ্যালি অক্সফোর্ড কলেজের ছাত্র, এই অবস্থাতেই তিনি কলেজের পক্ষ থেকে আকাশে নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা দায়িত্ব লাভ করলেন। এটা কম বড় কথা নয়। তার গন্তব্যস্থল ছিল দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্ট হেলেনা। এটা ছিল দক্ষিণ গোলার্ধের সর্বদক্ষিণের একটি নির্জন দ্বীপ।

উল্লেখ্য যে, এখানেই পরবর্তীকালে সম্রাট নেপোলিয়নকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং তিনি এখানেই মারা গিয়েছিলেন। অ্যাডমন্ড হ্যালি এখানেই এসেছিলেন গবেষণা করার জন্য, কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার এই অভিযান সম্পূর্ণ সফল হয়নি। আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য তিনি গবেষণা চালাতে পারলেন না।

তিনি ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের সেন্ট হেলেনাতে যান এবং ফিরে এসেছিলেন ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে। কিন্তু এত অল্প সময়েই তিনি অনেক কাজ করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ গোলার্ধের ৩৪১ টি নক্ষত্রের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের অবস্থান নির্ণয় করেন। শুক্র গ্রহের গতিপথও নির্ণয় করেন।



তিনি আকাশে নক্ষত্রের উপর দূরবীন দিয়ে গবেষণা চারাতে গিয়ে লক্ষ্য করেন যে, মহাকাশের কিছু কিছু নক্ষত্রের আলো ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। হ্যালি দক্ষিণ গোলার্ধের এক বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নক্ষত্রের যে ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন, সেটা প্রকাশিত হয় ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে।

দক্ষিণ আকাশের নক্ষত্র গণনার উপর এটাই ছিল প্রথম গবেষণা এবং প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে অ্যাডমন্ড হ্যালির নাম সরিয়ে পড়ে এবং তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তার এই কৃতিত্বের জন্যই তিনি ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।

শুধু তাই নয় তার কৃতিত্বের জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাকে কোর্স কমপ্লিট না করা সত্ত্বেও মাস্টার ডিগ্রী প্রদান করেন। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডমন্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এসে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন আইজ্যাক নিউটনের দারুন নামডাক। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান আকর্ষণ এবং রয়েল সোসাইটির সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য।

তখন অ্যাডমন্ড হ্যালি রয়েল সোসাইটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। যেখানে রয়েছে নিউটনের মত বিজ্ঞানীরা, রয়েছেন জীবাণু আবিষ্কারক বিজ্ঞানী রবার্ট হুক এবং বিখ্যাত স্থপতি স্যারে ক্রিস্টোফারের মতো বিজ্ঞানী, সেখানে সদ্য সদস্য অ্যাডমন্ড হ্যালি একেবারেই ছেলেমানুষ। উপরের এই ডাকসাইটে বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের গ্রহরাজির গতিবিধির উপরও গবেষণা করেছিলেন।

কিন্তু তারা একটা সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না। গ্রহগুলো যে সূর্যকে পরিক্রমণ করে তার পেছনে রয়েছে একটি অদৃশ্য শক্তি। কিন্তু সেই শক্তিটা কি তা তারা কখনো সনাক্ত করতে পারছিলেন না। কোন শক্তি গ্রহরাজিকে এভাবে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এটাই তারা বের করার চেষ্টা করছিলেন।

হ্যালি ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন ভূপৃষ্ঠের একটি মানচিত্র। এতে সাগর ও স্থলভাগের বায়ু চলাচলের একটি নিখুঁত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। এটাই পৃথিবীর সর্বপ্রথম ভৌগলিক আবহাওয়া মানচিত্র। এছাড়া তিনি ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের চৌম্বকক্ষেত্রের তালিকা।

১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে হ্যালি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এরপর থেকে তিনি পৃথিবীর অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের কাজ শুরু করেন। হ্যালির জীবনে সর্বাপেক্ষা বড় কাজ হল হ্যালির ধুমকেত আবিষ্কার। তিনি মহাকাশ নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেন। বিশেষ করে তিনি সৌরজগতের সবচেয়ে বৃহত্তম ধূমকেতুর পরিক্রমণ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন।

ধুমকেতু নিয়ে তার গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় তার এ সিনপসিস অব দি অ্যাস্ট্রোনমি অব কমেটস গ্রন্থে। এই গ্রন্থে তিনি সৌরজগতের ২৪টি উল্লেখযোগ্য ধূমকেতুর গতিপথ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি এই গ্রন্থে দেখান যে, গত ১৫৩১, ১৬০৪ ও ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে পরপর যে তিনটি বড় ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটেছিল এটা আসলে তিনটি পৃথক ধূমকেতন নয়, এটি একটি ধুমকেতুরই বারংবার আগমন।

অর্থাৎ একটি ধুমকেতুই নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ঘুরে ঘুরে আসছে। আসলে গ্রহদের মতো ধুমকেতুরাও তাদের নিজস্ব কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। পরে এই ধুমকেতুটিরই নামকরণ করা হলো হ্যালির ধূমকেতু নামে। হ্যালি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই ধুমকেতুটি আবার আকাশে দেখা দেবে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে, হ্যালির গণনা ঠিক হয়েছিল।

হ্যালির মৃত্যু ১৬ বছর পর যথাসময়ে এটি আবার দেখা দিয়েছিল আকাশে। আসলে হ্যালির ধূমকেতুর আবিষ্কারক হিসেবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এখনও হ্যালি অমর হয়ে আছেন। তিনি ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধের গতিপথ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। এছাড়া সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব কত এটাও হ্যালি আবিষ্কার করেন।

হ্যালির জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসামান্য সাফল্যের কারণে তার শিক্ষক ফ্লেমস্টীডের মৃত্যুর পর হ্যালিই রয়েল সোসাইটির প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত রয়েল সোসাইটিতে কর্মরত ছিলেন এবং অব্যাহত গতিতে চলেছিল তার মহাকাশ গবেষণা। বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালির জীবনাবসান হয় ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই জানুয়ারি। কিন্তু আজও তিনি বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও হাসপাতালর শল্যচিকিৎসকরা একবাক্যে স্বীকার করতেন যে, একটি রোগীকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *