জীবনী: ম্যাক্স প্লাঙ্ক

জীবনী: ম্যাক্স প্লাঙ্ক বর্তমান শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের সাফল্য হলো কোয়ান্টাম থিওরি আবিষ্কার। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিষ্কার বলতে গেলে একেবারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের নায়ক হলেন জার্মানের সুবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক।

১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ম্যাক্স প্লাঙ্ক বস্তু এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় উপকরণের মধ্যে শক্তির পরিবর্তনের একটি পার্থক্য নির্দেশ করতে সক্ষম হন। এই তত্ত্বটিই ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত কোয়ান্টাম থিওরি নামে খ্যাতি লাভ করে।
এই যে কোয়ান্টাম বা পরিমাপ এটি কিন্তু পদার্থের সাধারণ শ্রেণীবিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির।

পরবর্তীকালে এই কোয়ান্টাম থিওরিই জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়। কোয়ান্টাম থিওরি আবিষ্কারের ফলেই বিজ্ঞানের বাস্তব প্রতিফলনের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার এক বিশাল দরজা খুলে যায়। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম থিওরি বলতে কি বোঝায় তা অতি সাধারণ ভাষায় বলে বোঝানো মুশকিল।

কারণ এটি বিজ্ঞানের একটি জটিল ও সুক্ষ্ম তত্ত্ব। কারিগরি জ্ঞান না থাকলে এটা অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। সাধারণ ভাষায় বললে যা বোঝায় তা হলো, কালের বিবর্তনে পৃথিবীর বিভিন্ন পদার্থ তার নিজ নিজ দেহে তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ শোষণ করে। এসব পদার্থের বিকরণ শোষণ করার ক্ষমতা বা পদ্ধতি এক নয়।

এক এক পদার্থ এক এক শক্তিতে শোষণ করে এবং প্রত্যেকের শোষণ করার শক্তির একটি পরিমাপ আছে। এই যে পদার্থের বিকিরণ শোষণ করার শক্তির পরিমাপ একেই বলে কোয়ান্টাম। কোয়ান্টাম একটি ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ পরিমাপ। বিদ্যুৎ চৌম্বকত্ব, শক্তিশালী ও দুর্বল বলগুলো এবং বিশ্বের এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সমস্ত কণাকে ব্যাখ্যা করতে কোয়ান্টাম থিওরি সক্ষম।

এই তত্ত্ব পদার্থবিদ্যার সম্পূর্ণ নতুন একটি শাখার জন্ম দিয়েছে। এই তত্ত্ব অনুসারে সমস্ত ভৌত প্রক্রিয়াই বিভিন্ন শক্তিক্ষেত্রের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল। শক্তিক্ষেত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গে বিশেষ একটি ধরনে কম্পমান রয়েছে। কম্পনের এই বিশেষ ধরণটি আবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। এখান থেকেই কোয়ান্টাম থিওরির উৎপত্তি।

এই কোয়ান্টাম থিওরি এতোই জটিল যে, যখন এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল তখন বিশ্বের সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, ঝানু ঝানু পদার্থবিজ্ঞানীরাই কিছু বুঝতে পারেনি। একমাত্র আইনস্টাইন ছাড়া আর কোন বিজ্ঞানী এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি। এর সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে বিজ্ঞানীদের অনেক সময় নিতে হয়েছিল ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ম্যাক্স প্লাঙ্কের এই কোয়ান্টাম থিওরি বিজ্ঞানীরা মেনে নেননি।

অর্থাৎ তারা বুঝতেই পারেনি এটি আসলে কি। দীর্ঘ সময় পরে তারা অবশেষে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে কোয়ান্টাম থিওরি পদার্থবিজ্ঞানের যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। কারণ পদার্থের বিকিরণের তারতম্যের দ্বারাই বোঝা যাবে কোন পদার্থের বয়স কত। কত আগে এর বিকিরণ পরিবর্তিত হয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছে।

এটি লাখো বছর আগে কি পদার্থ ছিল, তার কিভাবে পরিবর্তন এসেছে, সবকিছু জানা যাবে এই কোয়ান্টাম থিওরি দ্বারা। যে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম থিওরি কি বুঝতে না পেরে তাকে অবহেলা অস্বীকার করেছিলেন তারাই এর গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, ডি ব্রেজলে রাদারফোর্ড, ডেভিশন, পোলি, হেইসেনবার্গ, স্ক্রোডিংগার প্রমুখ বিজ্ঞানী অবশেষে একবাক্যে স্বীকার করেছেন কোয়ান্টাম থিওরির গুরুত্ব। আজ এই থিওরি পদার্থবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কোয়ান্টাম থিওরির আবিষ্কর্তা ম্যাক্স প্লাঙ্কের পুরো নাম ম্যাক্স কার্ল ইমস্ট লুডউইং প্ল্যাংক।

তার জন্ম হয়েছিল জার্মানের কিইল নামক শহরে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল। তার পিতা জুলিয়াস ওইলহেম ছিলেন কিইল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক। পরে তিনি গর্টেজিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছিলেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মিউনিকে। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য এসে ভর্তি হন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি দুজন বিখ্যাত বিজ্ঞানের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরা হলেন কিরচিফ এবং হেলমবাল্টজ। এরা দুজনেই অসাধারণ প্রতিভাবান ছাত্র ম্যাক্স প্ল্যাংককে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন।

এর পরেও তিনি ১৮৮০ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পদার্থবিজ্ঞানের উপর গবেষণা করেন। কোয়ান্টাম থিওরি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তিনি লাভ করেছিলেন তার শিক্ষক কিরচিফের কাছ থেকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়েই। এই থিওরির উপরে তিনি মিউনিকে এসেও গবেষণা চালান। তবে তখনই তিনি সাফল্য করতে পারেননি।



মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা পর্ব শেষ করে তিনি অ্যাসোসিইয়ের প্রফেসর হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন কিইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এখানে তিনি চার বছর অধ্যাপনা করেন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন ম্যাক্স প্লাঙ্কের শিক্ষক কিরচিফ।

তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এসে স্যারের এই শূন্যপদেই যোগদান করেন। জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ছাত্রজীবনের কিরচিফের অনুপ্রেরণাতেই তিনি সর্বপ্রথম তাপ বিকিরণবিষয়ক থার্মোডাইনামিকস বিদ্যার উপর গবেষণা করতে শুরু করেছিলেন। ক্রমে তিনি এই বিষয়টির উপর গভীরভাবে আগ্রহী ওঠেন।

তিনি থর্মোডাইনিকেল সমস্যার উপর অনেকগুলো গবেষণাপত্রও তৈরি করেন এবং পরে সেগুলো পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয়। তখন থার্মোডাইনামিকসের বিকিরণের কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এসব বিষয়ের উপর গবেষণার সময়ই তিনি শক্তির বিকিরণের সাথে আলোর রঙের পার্থক্য আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করছিলেন।

এভাবে গবেষণা করতে করতেই তিনি শক্তি এবং বিকিরণের মধ্যে একটি সংযোগ আবিষ্কার করছে সক্ষম হন। তিনি তার এই বিখ্যাত আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। পরে তার এই তথ্যই বিকিরণের থিওরি বলে খ্যাতি লাভ করে। কোয়ান্টাম থিওরি স্বীকৃতি লাভ করার পরেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে বিশ্বময়।

সারা ইউরোপের বিজ্ঞানী সমাজ তাকে জানাতে থাকেন অকুণ্ঠ অভিনন্দন। কোয়ান্টাম থিওরি আবিষ্কারের জন্যই তিনি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। তারপর ১৯২৬-এ তিনি লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে রয়েল সোসাইটির পক্ষ থেকে লাভ করেন কোপলে মেডেল।

ক্যান্সার চিকিৎসা বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য তাকে জার্মানির ওয়ালহেইম ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কারণ তার মত এত বড় একজন বিজ্ঞানের নাম জড়িত থাকলে এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে। দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের সময় তার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ। ম্যাক্স প্ল্যাংক ছিলেন ইহুদি।

কিন্তু জার্মানের একনায়ক হিটলার ছিলেন চরম ইহুদী বিদ্বেষী। হিটলার ক্ষমতা দখল করেই জার্মানে বসবাসকারী ইহুদিদের উপর শুরু করলেন অত্যাচার। হিটলারের অত্যাচারে অনেক ইহুদি দেশ ছেড়ে পালালেন। কিন্তু ম্যাক্স প্লাংক গেলেন না। তিনি ছিলেন অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী। জার্মানি তার জন্মভূমি।

এটা তার নিজের দেশ। নিজের দেশ ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন? তিনি নিজের দেশকে ভালোবাসেন। নিজের কর্মকাণ্ড দ্বারা তিনি দেশের মঙ্গল করতে চান। বিদেশিদের কাছে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করতে চান। কিন্তু একনায়ক হিটলার এবং তার নাজি সরকার তাকে শান্তিতে থাকতে দিলেন না। তাকে নানাভাবে হয়রানি এবং নাজেহাল করতে লাগলো নাজি বাহিনীর লোকেরা।

এই সময়টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বেদনা দায়ক অধ্যায়। তারপর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার জীবনে নেমে এলো চরম বিপর্যয় এবং ধস। এই চরম সর্বনাশাটাও করলো হিটলার বাহিনী। ১৯৪৪ সালের সহসা একটি মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে ম্যাক্স প্লাঙ্কের ছেলেটিকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হলো। আসলে মামলাটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যে।

তার ছেলে কখনো কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। শুধু ম্যাক্স প্লাংকে নাজেহাল করার জন্যই ছেলেকে হত্যা করা হলো। ছেলেকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলো না বর্বররা। ম্যাক্স প্লাঙ্কের নিজস্ব বাড়িটিও বোমা মেরে ধ্বংস করে ফেলল। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে ম্যাক্স প্লাংক একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন।

তিনি একেবারে নির্বাক ও নিচু হয়ে গেলেন। কাজকর্ম করার সমস্ত রকম ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। নির্বাক অবস্থাতেই বছর দুয়েক বিছানায় পড়ে ছিলেন। শেষে এই অবস্থাতেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৪ অক্টোবর তারিখে মারা যান। অথচ ম্যাক্স প্ল্যাংক ছিলেন অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে মানুষ।

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রতিভা ছাড়াও তার ছিল আরো অনেক মানবিক গুণাবলী। তার সব বন্ধু ও সহযোগীরা তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। শ্রদ্ধা করতেন তার ব্যক্তিগত গুণকে। বিজ্ঞান ছাড়াও তার আরেকটি গুণ ছিল। তিনি গান ভালবাসতেন।

গান গাইতে পারতেন। যৌবনে তো তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে তিনি গায়ক হবেন। কিন্তু বিশ্বের বিজ্ঞান জগতের সৌভাগ্য যে তিনি সংগীত শিল্পী হননি। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং বিশ্বকে দিতে পেরেছিলেন কোয়ান্টাম থিওরি।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল জীবজগতের এটি একটি বিরাট বিস্ময়। মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড় এবং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *