জীবনী: রজার বেকন

জীবনী: রজার বেকন বিজ্ঞান আজ উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু বিজ্ঞানকে এতোদূর পৌঁছে দিতে বিশ্বের যেসব মনীষী তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সারা জীবনের সাধনা দিয়ে যারা এর মূল ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রজার বেকন।

রজার বেকনই বলতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞানের মূল স্থপতি। বিজ্ঞানের বহু শাখা আজ চরম সফলতা লাভ করেছে। কিন্তু তার অনেক কিছুরই মূল ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলেন রজার বেকন। মহাকাশযান আজ আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিরাট বিস্ময়। কিন্তু এই মহাকাশযান বা রকেট আবিষ্কারের গোড়াতে রয়েছে রজার বেকনের বিরাট অবদান।রকেটের মূল ভিত্তি আতশবাজি।

বিভিন্ন বিস্ফোরণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আতশবাজি তৈরি হয়। আতশবাজির মূল উপাদান ব্ল্যাক পাউডার। ঐতিহাসিকগণ বলেন, রজার বেকন নামে জনৈক ইংরেজ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীই প্রথম ব্ল্যাক পাউডার আবিষ্কার করেন। বেকনই সর্বপ্রথম ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটিন ভাষায় আতশবাজির নির্মাণকৌশল এবং বিভিন্নরকম বিস্ফোরকের মিশ্রণ সম্পর্কে লেখেন। সে থেকেই এর উন্নতি শুরু।

প্রাচীন দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকনের জন্ম হয়েছিলো বৃটেনে ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে। তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আজ আর সঠিকভাবে কিছু জানার উপায় নেই। স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য এসে ভর্তি হয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। পরে প্যারিসে এসেও পড়াশোনা করেছিলেন বেশ কয়েক বছর।

রসায়নশাস্ত্রে উচ্চডিগ্রী লাভ করার পর তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। রজার বেকন ছিলেন অসম্ভব রকমের মেধাবী এবং প্রতিভাবান। তিনি তার যুগের তুলনায় ছিলেন চিন্তাচেতনায় বহু শতাব্দীর ব্যবধানে অগ্রগামী। তিনি বিজ্ঞানের সেই প্রাথমিক যুগে বাস করেও এমন সব ধ্যান ধারণা পোষণ করতেন যা তখনকার লোকেরা কল্পনাও করতে পারত না।

তিনি সেই ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই এমন সব সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যা তখন কেউ ভাবতেও পারেনি। তার ভবিষ্যদ্বাণীর সবকিছুই আবিষ্কৃত হয়েছিল তার মৃত্যুরও বহু শতাব্দী পরে। তিনি একাধারে ছিলেন ভাষাবিদও। গ্রীক এবং আরবি ভাষাও ভালো জানতেন।

কেউ কেউ বলেন– তিনি যে ব্ল্যাক পাউডার আবিষ্কার করেছিলেন তার মূল সূত্র তিনি পেয়েছিলেন আরবি গ্রন্থ থেকে। রজার বেকনের আগেই নাকি আরবরা বারুদজাতীয় পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন। আরবরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ব্ল্যাক পাউডারের উন্নয়ন ঘটায়। আরবি গ্রন্থ থেকে রজার বেকন এই ব্ল্যাক পাউডারের মূল সূত্র গ্রহণ করেন এবং তার উন্নয়ন করেন।

তবে মূলত তিনিই ব্ল্যাক পাউডারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দান করেন। ঐতিহাসিকগণ আরো বলেন, বারুদের আদি আবিষ্কার নাকি আরবদের নয়। বারুদ সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিলো চীনে। চীন থেকে এটা আরবরা আয়ত্ত করে এবং সেখান থেকে ব্রিটেনের বিজ্ঞানী রজার বেকনের হাতে এটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বিকশিত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে রজার বেকনের মতাদর্শ ছিলো অ্যারিস্টটলীয় যুগের।

গ্রন্থপাঠ করে মৃদু তত্ত্বজ্ঞান আহরণ করে লাভ নেই, তার চেয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞনের চর্চা করা অনেক শ্রেষ্ঠ। তিনি কখনো ভাববাদী আদর্শে বিশ্বাস করতেন না। হাতেকলমে প্রমাণ না পেলে তা বিশ্বাস করতেন না। যা কিছুই হোক, তা অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক।

তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে বারো শোর উপরে। এর মধ্যে অন্যতম ব্ল্যাক পাউডার। এ ছাড়া তিনি গান পাউডার নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি চুম্বকদণ্ডও আবিষ্কার করেন। তারপর দূরবীক্ষণ-এর গঠন কাঠামো নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। তবে দূরবীক্ষণের সত্যিকার আবিষ্কারক হলেন গ্যালিলিও।

তিনি রজার বেকনেরও অনেক পরে এটি আবিষ্কার করেন। অথচ টেলিস্কোপ আবিষ্কারেরও বহু বছর আগেই বেকন এ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পৃথিবী যে গোল এটাও আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক পরে। ষোড়শ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম ম্যাগেলান ভূ-প্রদক্ষিণ করে আসার পরই হাতেনাতে প্রমাণিত হয় যে পৃথিবী গোলাকার। অথচ এরও তিনশো বছর আগেই রজার বেকন বিশ্বাস করতেন- পৃথিবী গোলাকার।

তিনি বলেছিলেন, আটলান্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম দিকে জাহাজ চালিয়ে গেলে এশিয়া মহাদেশে পৌঁছানো যাবে। এরও অনেক পরে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস এশিয়া মহাদেশে পৌছোনোর উদ্দেশে আটলান্টিক মহাসাগর ধরে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছিলেন। তিনি এশিয়া মহাদেশে পৌঁছোতে পারেননি সত্য, কিন্তু আবিষ্কার করেছিলেন আরেক পৃথিবী- আমেরিকা মহাদেশ।



এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী তিনি আরো করেছিলেন, যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা তখনো মানুষ কল্পনাও করতে পারত না। কিন্তু তিনি তার অস্বাভাবিক মেধাশক্তি ও দূরদর্শিতা দিয়ে এদের আবিষ্কারের আগাম খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে যেদিন সমুদ্রের বিশাল জাহাজ চালাতে আর মানুষের দরকার হবে না।

শুধু একজন মানুষের পক্ষেই একটি জাহাজকে অনাসায়ে চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। রজার বেকন এই কথার দ্বারা যান্ত্রিক জাহাজের কথা বলেছিলেন। অথচ তখনো যান্ত্রিক জাহাজের কথা কেউ কল্পনাও করেনি। রজার বেকনের যুগেও জাহাজ চলত পালের সাহায্যে। অথচ সেই যুগে তিনি এমন অগ্রিম চিন্তা করতেন। শুধু সামুদ্রিক জাহাজ নয়, ডাঙার গাড়ি নিয়েও তিনি এমনি একটি আগাম কথা বলেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, এমন দিন আসবে যেদিন গাড়ি টানার জন্য আর ঘোড়া কিংবা গরু-মহিষের দরকার হবে না। তখন এর গতি হবে অনেক দ্রুত। জল এবং ডাঙার পর তিনি আকাশযানের কথাও বলেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যেদিন তৈরি হবে এক বিচিত্র জাতের মেশিন, যা পাখির মতো আকাশে উড়তে সক্ষম হবে।

শুধু মেশিন একাই আকাশে উড়বে না, তাতে মানুষও চড়তে পারবে এবং মেশিন পরিচালনা করতে পারবে। মজার ব্যাপার হলো, রজার বেকনের কল্পনার এই উড়ন্ত মেশিন আবিষ্কৃত হয়েছিলো বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে রাইট ব্রাদার্স প্রথম উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেন, রজার বেকনের মৃত্যুরও সাতশো বছর পরে।

তিনি এমনি আরেকটি চমকপ্রদ মন্তব্য করেছিলেন, ভবিষ্যতে নদীর উপর এমন চমৎকার সেতু তৈরি হবে, যাতে কোনো খুঁটি বা থাম থাকবে না। তিনি সম্ভবত আধুনিক ঝুলন্ত সেতুর কথা বলেছিলেন। ঝুলন্ত সেতুর কারিগরি কৌশল আবিষ্কৃত হয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। রজার বেকনের মৃত্যুর সাড়ে সাতশো বছর পরে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে এই যে অদ্ভুত সব মন্তব্য তিনি করতেন তা কিন্তু মজা করার জন্য তিনি বলতেন না।

তিনি এসব শুধু মুখে বলতেন না। রীতিমত যুক্তিতর্ক ‍দিয়ে লিখিত আকারে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে বলতেন। কিন্তু তখনো সাদারণ মানুষ তার এই বহু শতাব্দীর অগ্রগামী চিন্তাধারা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। এমনকি দেশের বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিত ব্যক্তিরাও তার এসব উদ্ভট কথা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তারাও তাকে এ ধরনের উদ্ভট কল্পনা ছড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য বলতেন।

কিন্তু তিনি শুনতেন না। এর ফলে তার প্রতি লোক গেলো ক্ষেপে। অনেকেই তার শত্রু হয়ে গেলো। কিন্তু এর মধ্যে একজন মানুষ শুধু তাকে সমর্থন দিতে লাগলেন এবং তার এই অগ্রগামী চিন্তার ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলেন। তিনি হলেন পোপ ক্লিমেন্ট ৪র্থ। তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও রজার বেকন গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

তিনি ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের উপর রচনা করতে লাগলেন একের পর এক গ্রন্থ। তিনি একটানা ১৮ মাস লিখে রচনা করলেন এক বিশাল গ্রন্থ। তখনো তো মুদ্রণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বই বলতে বোঝানো হতো হাতে লেখা বই। তখন ছিলো না লেখারও কোনো সরঞ্জাম। তবু তিনি রাতদিন খেটে তৈরি করলেন তার গবেষণাগ্রন্থসমূহ। তার এই গ্রন্থগুলোর নাম ছিলো ওপাস মাজুস, ওপাস মিনাস এবং ওপাস টারটিয়াস।

এই সবগুলো গ্রন্থই তিনি রক্ষণাবেক্ষণ ও গঠনের জন্য পাঠালেন তার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী পোপ ক্লিমেন্টের কাছে। পোপ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন শত্রু তার কোনো ক্ষতি করতে সাহস পায়নি। দূরে থেকে সমালোচনা করেছে। হয়তো গালাগালও দিয়েছে, কিন্তু গায়ে হাত দেবার সাহস কারো হয়নি। কিন্তু ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্টের মৃত্যুর পরই রজার বেকনের বিপদ ঘনিয়ে এলো।

এতোদিন যারা তার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলো, শত্রুতা করতো, তারা এবার তাকে অসহায় পেয়ে আক্রমণ করে বসলো। প্রভাবশালী শত্রুদের চক্রান্তে তিনি এবার গ্রেফতার হলেন। তাকে ধরে বিচার করে জেলে পাঠানো হলো। তিনি জেলে ছিলেন একটানা চোদ্দ বছর। তবে জেলেও তিনি বসে ছিলেন না। জেলে বসেও চালিয়ে গেছেন তার গবেষণা বই লেখা।

অনেক পরে নতুন পোপ নিকোলাস ৪র্থ এলেন। তিনিও ছিলেন ক্লিমেন্টের মতোই গুণগ্রাহী। এবার রজার বেকন তার জেলে বসে লিখিত বইগুলো পাঠিয়ে দিলেন নতুন পোপের কাছে। নিকোলাস তার জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ পাঠ করে খুবই চমৎকৃত হলেন এবং তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য রাজাকে অনুরোধ করলেন। রজার বেকন হলেন মুক্ত।

জেল থেকে যখন বেরিয়ে এলেন তখন তার প্রায় বৃদ্ধ বয়স। তবু তার ছিলো অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য। তিনি আবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা শুুরু করলেন। শুরু হলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কিন্তু মনের উৎসাহ থাকলেও শরীর তার ভেঙে পড়েছিলো। তিনি আর আগের শক্তি ফিরে পেলেন না। তারপর ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই অক্সফোর্ডেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু বিজ্ঞানজগৎ তাকে স্মরণ করবে চিরকাল।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল

জীবনী: জোহান মেন্ডেল জীবজগতের এটি একটি বিরাট বিস্ময়। মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম পোকামাকড় এবং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *