জীবনী: হামফ্রে ডেভি

জীবনী: হামফ্রে ডেভি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ মুহূর্ত। ইংল্যান্ডের সমুদ্রের ধারে ছোট্ট একটি শহর পেনজান্স। প্রায়ই দেখা যেত একটি বছর দশকের ছেলে জনহীন সমুদ্রের ধার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার পকেট ভর্তি নানারকম শামুক, ঝিনুক আর হরেক রকমের সামুদ্রিক প্রাণীর খোলস। এগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে এসেছে তীরে। কিছু নুড়িপাথরও আছে তার সাথে।

ছেলেটির অদ্ভুত রকমের যতো শখ। যা কিছু নতুন দেখবে, সবকিছুতেই তার প্রচন্ড আগ্রহ। এই ছেলেটির নামই হামফ্রে ডেভি। একজন বিজ্ঞানী, যিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিরাপদ বাতি, যা আবিষ্কার হওয়ার ফলেই বিশ্বের লাখো লাখো খনি শ্রমিকের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। তার জন্য বিশ্বজুড়ে বয়ে এনেছিলো খ্যাতি এবং সুনাম।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে খনি, বিশেষ করে কয়লা খনি নিয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। খনিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটতো। মারা যেত হাজার হাজার শ্রমিক। সেকালে খনির ভিতরে শত শত ফুট মাটির নিচে শ্রমিককে কয়লা কাটতো। খনির ভেতরের অন্ধকার দূর করার জন্য থাকতো মাশালজাতীয় বাতি।

খনির ভেতরে নানারকম গ্যাস থাকে। এইসব গ্যাসের জন্য আলোর শিখা জ্বলে উঠে ঘটায় প্রচন্ড অগ্নিকাণ্ড। এমন দুর্ঘটনা প্রায় ঘটতো। এই সমস্যার কেউ সমাধান করতে পারছিল না। অবশেষে এই সমস্যারই সমাধান করলেন স্যার হামফ্রে ডেভি। তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করলেন এমন এক ধরনের নিরাপদ বাতি যার আলো আছে তীব্র কিন্তু মশাল বাতির মত শিখা নেই।

এই বাতির আলো খোলা নয়। তাই গ্যাসের সংমিশ্রণে এসে জ্বলেও উঠতে পারে না, দুর্ঘটনাও ঘটে না। রক্ষা পেল পৃথিবীর হাজার হাজার খনি শ্রমিক। বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভির জন্ম হয়েছিল ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই ডিসেম্বর বৃটেনের সমুদ্রের ধারে পেনজান্স নামে একটি ছোট্ট শহরের উপকণ্ঠে। ডেভি কোন বড়লোকের সন্তান ছিলেন না। বাবা ছিলেন ছুতোর মিস্ত্রি।

কাজেই ডেভির বেশিদিন স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। ডেভির যখন মাত্র ১৬ বছর বয়স তখনই তার পিতার মৃত্যু হয়। ডেভি ছিলেন মা-বাবার বড় ছেলে। তার ছিল আরো চার ভাইবোন এবং বিধবা মা। পুরো সংসারের দায়-দায়িত্ব এসেছে চেপে যায় তার উপর। বাবা বেঁচে থাকতে অবশ্য কিছুদিন গিয়েছিলেন স্থানীয় স্কুলে। পড়াশুনায় অবশ্য খুব ভালো ছিলেন তিনি।

বিশেষ করে কবিতা আবৃত্তি এবং গল্প বলায় তার ছিল অসম্ভব রকম দক্ষতা। সেদিক দিয়ে তিনি কবি হতে পারতেন, কিন্তু হলেন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষণও তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল বাল্যকালেই। ছোটবেলা থেকেই তার মন ছিল ভারি কৌতূহল প্রিয়। সাগর পাড়ের ঝিনুক, শামুক, পাথর এ নিয়েও ছিলো তার কৌতূহল।

এসব কুড়িয়ে এনে বাড়িতে জড়ো করতেন। তারপর কিশোরসুলভ অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। কিন্তু অকস্মাৎ বাবার মৃত্যুর পরই তার জীবনে নেমে এলো কষ্টের বাস্তবতা। পিতার মৃত্যু হল স্কুলের পড়া গেলো বন্ধ হয়ে। স্কুলের প্রাথমিক বিভাগ শেষ করেই তাকে ঢুকে পড়তে হলো এক ঔষধের কারখানায় শিক্ষানবিসির কাজে।

কারণ তখন থেকেই কিছু রোজগারের পথ খুঁজে বের করতে না পারলে সংসার চলবে কেমন করে? এই ওষুধের কারখানার যিনি মালিক ছিলেন তার ছিল বই পড়ার নেশা। ফলে তিনি তার নিজস্ব একটি ভালো লাইব্রেরী তৈরি করেছিলেন। ডেভি কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই সেই লাইব্রেরীতে বসতেন এবং বই পড়তেন।

লাইব্রেরিতে ছিলো প্রচুর বিজ্ঞানী বই। সেকালে বিজ্ঞান ততটা অগ্রসর না হলেও ল্যাভসিঁয়ে, নিকলসন প্রমুখ বহু বিজ্ঞানীর পরীক্ষার ফল দেওয়া ছিলো এসব বইতে। ডেভির সে বইগুলো এত ভালো লেগে গেল যে তিনি ঠিক করলেন জীবনের ব্রত হিসেবে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে রসায়ন বিজ্ঞান তার খুবই ভালো লাগতো। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। নিজে সুযোগ পেলেই নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে দিতেন।



ডেভি এই ওষুধ কারখানায় ছিলেন ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি চলে আসেন বৃস্টলে। এখানে নিউমেটিক ইনস্টিটিউশনে সুপরিনটেনডেন্ট-এর পদ গ্রহণ করেন। এই ইনস্টিটিউশনের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে ঔষুধের কোনো কার্যকারিতা আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা। এই প্রতিষ্ঠানেই ডেভি বিভিন্ন গ্যাসের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন।

তিনি ল্যাবরেটরিতে নাইট্রাস অক্সাইড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতেই এর একটি বিশেষ গুণের সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি এই নাইট্রাস অক্সাইড থেকেই তৈরি করলেন এক নতুন এবং বিচিত্র ধরনের গ্যাস। এই গ্যাস নিজে শুঁকতে গিয়ে তার হলো এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তার শরীরের বোধশক্তি যেনো কমে আসছে এবং সেই সাথে ভেতরে কেমন একটা অসম্ভব কৌতুকেরও সৃষ্টি হচ্ছে। তার হাসিও পাচ্ছে।

শরীরের জ্বালাযন্ত্রণা লোপ পাচ্ছে। তিনি ভাবলেন এই গ্যাসটা তো তাহলে ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগী যদি অস্ত্রোপচারের সময় যন্ত্রণা অনুভব না করে, তাহলে খুব ভালো হবে। এর কিছুদিন পর দাঁত তোলার সময় ব্যবহার শুরু হল গ্যাসটার। দাঁত তোলার সময় রোগী যে অসম্ভব যন্ত্রণা পায়, তা ভুক্তভোগিরাই জানে। এই গ্যাসটার আসল নাম নাইট্রাস অক্সাইড।

কিন্তু গন্ধ নাকে নিলে হাসি পায়। এর আরো একটা নাম হল লাফিং গ্যাস। এই গ্যাস যখন আবিষ্কৃত হয় তখন প্রথম প্রথম এটা নিয়ে অনেক মজার মজার কান্ড ঘটতো। প্রথমে এটা একটা মজার খেলা হিসেবেই অনেকে ব্যবহার করতো। লোক হাসবার জন্যেই এটা অনেকে নিতো কৌতুকের জন্য। একবার এই নিয়ে ঘটলো এক মজার এবং শেষে বিচ্ছিরি কান্ড।

এক মেয়ে মজা করার জন্য এই গ্যাস শুঁকলো খুব বেশি মাত্রায়। আর তার পরই তার বোধশক্তি এবং জ্ঞান বুদ্ধি লোভ পেয়ে গেলো। সে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। শুধু তাই নয়, হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়ে নেমে এলো রাস্তায়। তখনও সে প্রচণ্ড জোরে হাসছে। আর জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে। আর অমনি করে ছুটতে ছুটতে পড়বি তো পড় গিয়ে পড়লো এক কুকুরের উপর। ভাগ্যিস পাশের এক লোক দেখে ফেলেছিল কাণ্ডটা।

তিনি ছুটে এসে রক্ষা করলেন মেয়েটাকে। এই ঘটনার পর থেকেই লাফিং গ্যাসের যথা ইচ্ছা ব্যবহার অনেকটা কমে যায়। পরে এই গ্যাসকে শুধু চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হয়। তখনকার একজন নামকরা বিজ্ঞানী ডেভির এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানতে পেরে তাকে একদিন বিলাতের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট গিলবার্টের কাছে নিয়ে গেলেন।

গিলবার্ট ডেভির সাথে কথা বলে খুশি হলেন এবং সাথে সাথে তাকে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দিলেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ডেভি বৃস্টল ছেড়ে চলে এলেন লন্ডনে। তখন বিজ্ঞানী হিসেবে তার নাম হয়ে গেছে। তিনি লাফিং গ্যাসের আবিষ্কারক বলে চারিদিকে পরিচিত। এই বিশেষ গুণের জন্যই শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু প্রতিভার কারণেই তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ পেলেন।

১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যুৎ প্রবাহের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি কস্টিক পটাশ দিয়ে তৈরি করেন নতুন ধরনের ধাতু পটাশিয়াম। এছাড়াও তিনি রসায়নশাস্ত্রের আরো বহু জিনিসের উপর গবেষণা করেছেন। যেমন ব্যারিয়াম, ক্যালসিয়াম, স্টোনটিয়াম ক্লোরিন এবং আয়োডিন ইত্যাদি নিয়েও বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে আবিষ্কারটি করেন, সেটার জন্যই তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তার এই বিশ্বখ্যাত আবিস্কারটিই ছিলো নিরাপদ বাতি যার কথা আগেই বলেছি। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সর্বশেষ ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বের হন সারাদেশব্যাপী বিজ্ঞান বক্তৃতামালা প্রদানের জন্য।

কিন্তু এতোখানি পরিশ্রম তার শরীর সহ্য করতে পারল না। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে মে তারিখে তিনি পৌঁছেলেন জেনেভায়। কিন্তু এখানে আসার পরের দিনই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। বিদেশের মাটিতে আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু হলেও তার বিজ্ঞান গবেষণার জন্য পৃথিবীর মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ করবে।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

এগুলো দেখুন

জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার

জীবনী: জোসেফ লিস্টার ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও হাসপাতালর শল্যচিকিৎসকরা একবাক্যে স্বীকার করতেন যে, একটি রোগীকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *