জীবনী: লুইজি গ্যালভানি

লুইজি গ্যালভানি

জীবনী: লুইজি গ্যালভানি বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিন। কিন্তু বিদ্যুৎকে যিনি শক্তিররূপে ব্যবহার করে এবং জীবদেহে এর অস্তিত্ব আবিষ্কার করে নবযুগে সূচনা করেছিলেন তিনি হলেন ইতালি বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তিনিই প্রথম এক ধরনের বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরি করেন, যার মধ্যে থেকে নিয়মিত বিদ্যুৎপ্রবাহ চলতে সক্ষম হয়। তিনি এই ব্যাটারির সাহায্যেই জীবন্ত প্রাণীর দেহেও বিদ্যুতের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি একটি মৃত ব্যাঙের দেহে সর্বপ্রথম এই বিদ্যুৎ প্রবাহের ব্যবস্থা করেন।

এই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার পর মৃত ব্যাঙটিও লাফাতে থাকে। এতেই সকলে তাকে তামাশা করে ব্যাঙ নাচানোর বিজ্ঞানী বলতেন।গ্যালভানির জন্ম হয় উত্তর ইতালির বোলোগ্না শহরে ১৭৩৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে। গ্যালভানির পিতা ছিলেন ডাক্তার।

তাই বাবা চেয়েছিলেন ছেলেও তার পেশাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেবে। অতঃপর ডাক্তারি পড়ার জন্যই গ্যালভানিও বোলোগ্না বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৭৫৯ সালে। ১৭৬২ সালে হারের গঠন বৃদ্ধির উপর থিসিস লিখে মেডিসিনের উপর ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যানাটমির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।

এ ছাড়াও তিনি একই সাথে ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড সাইন্স নামে অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সেই বছরই অর্থাৎ ১৭৬২ সালেই তিনি লুসিয়া নামে এক বিদুষী মেয়েকে বিয়ে করেন। লুসিয়া ছিলেন বোলাগ্না একাডেমি অব সাইন্স এর অধ্যাপক গ্যালেয়াজির মেয়ে।

উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে ১৭৭২ সালে গ্যালভানি নিজেও এই সাইন্স একাডেমির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থিসিস লেখার সময় থেকে গ্যালভানির গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল অ্যানাটমি। যেমন মূত্রশয়ের নল, নাকের শৈষ্মিক ঝিল্লি এবং কানের অভ্যন্তরীণ গঠনসহ শরীরসম্পর্কিত বিষয়াদি।

পরবর্তী সময়েও একই বিষয়কে তিনি আরো উন্নত সুসংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানাটমির উপর বক্তৃতা দিতে দিতেই তার এই ধারণা জন্ম হয়। তিনি সর্বপ্রথম ১৭৭৩ সালে ব্যাঙের উপর গবেষণা করে এই সাফল্য লাভ করেন।

১৭৭০ সাল থেকে জীবদেহের মাংসপেশিতে স্থির বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করা যায় কিনা তার উপর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তার রেখে যাওয়া নোটবুক থেকে জানা যায় তার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল প্রাণিবিদ্যুৎ সম্পর্কে তথ্য আরোহন করা। এই ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি একটি মৃত ব্যাঙের দেহে পরীক্ষা চালান।

বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটিয়ে একটি কাঁচি ব্যাঙের শরীরে প্রবেশ করিয়ে ব্যাঙের শরীরের শিরায় টিস্যুর গঠন প্রকৃতির পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। একদিন তার ঘরে এসে জনৈক লোক দেখতে পান যে, একটি মেশিন চালু করার সাথে সাথে একটি চামড়া ছাড়ানো মৃত ব্যাঙও কেমন করে লাফিয়ে উঠছে। আসলে ব্যাঙটি সহসা জীবিত হয়ে যায়নি।

তার শরীরে টিস্যুতে বিশেষ কায়দায় বিদ্যুৎপ্রবাহের সৃষ্টির ফলেই তার শরীরে টিস্যুর পরিবর্তন হয়েছে এবং তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি এই নিয়ে আরো গবেষণা করতে চেয়েছিলেন তিনি ইলেকট্রোস্ট্যাটিক মেশিনের সাহায্য ছাড়াই শুধু কপার হুক দিয়ে ব্যাঙের স্পাইনাল কর্ড বা সুষুশ্মকাণ্ডে আঘাত করে এবং সেটিকে লোহার শিকে ঝুলিয়েও এই কাণ্ড করতে চেয়েছিলেন।

তবে গ্যালভানির এই সূত্র প্রকাশে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে। ১৭৯১ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত থিসিস কমেন্টারি অন দি ইফেক্ট অব ইলেকট্রিসিটি অন মাসকুলার মোশান। এটি গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয় আরো দেড়শত বছর পরে ১৯৫৩ সালে।



তিনি গবেষণা করে বের করেন যে, প্রত্যেক প্রাণীদেহের টিস্যুতেই একটি সহজাত ও সুপ্ত শক্তি আছে, তিনি যার নাম দিয়েছেন প্রাণীবিদ্যুৎ। যখন কোন ধাতুর শলাকা দিয়ে আঘাত করা হয় তখনই সেই সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হয়। এই নতুন জাগ্রত শক্তিটাই হলো প্রাণীদেহের বৈদ্যুতিক শক্তি।

তিনি বলেন, প্রাণীদেহের মস্তিষ্ক হলো এই তড়িৎশক্তি উৎপাদনের মূল আধার। মস্তিষ্ক থেকেই বিদ্যুৎপ্রবাহ শরীরের নার্ভ ও টিস্যুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিদ্যুৎপ্রবাহ শরীরের টিস্যুতন্তুকে সঞ্জিবীত করে। গ্যালভানির এই সূত্র কে তার সহকর্মীকগণ সহজে গ্রহণ করে নেন। তবে একজন মাত্র লোক তার সূত্রের বিরোধিতা করেন।

তিনি প্যাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালোসান্দ্রো ভোল্টা হলেন। ভোল্টা বলেন, বিদ্যুৎপ্রবাহের ফলে যে ব্যাঙের পা নড়ে উঠেছে সেটা হলো ইলেক্ট্রোস্কোপেরই প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, যখন দুটো ভিন্নধর্মী পদার্থের সংযোজন ঘটে তখনই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেখানে ধাতব বিদ্যুৎই কাজ করে, প্রাণীর টিস্যুর কোন কাজ নেই।

এটা ইলেক্ট্রোস্কোপেরই সক্রিয় হওয়ার ফল, অন্য কিছু নয়। কিন্তু গ্যালভানি ভোল্টারের এই প্রতিবাদে দমে গেলেন না। তিনি প্রাণীদেহের মাংসপেশিতে একই ধরনের ধাতু দিয়ে পরীক্ষা করে একই ফল পেলেন। বহু তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে বিজ্ঞানী ভোল্টা গ্যালভানির আবিষ্কার কে মেনে নিলেন। শুধু মেনেই নিলেন না।

বিদ্যুতের এই চমৎকার আবিষ্কারের ফলে তিনি নিজেই অবশেষে বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি শেষে গ্যালভানির আবিষ্কারকে প্রকাশ্যে “একটি সুন্দর ও চমৎকার আবিষ্কার” বলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
ভোল্টা গ্যালভানির প্রশংসা করলেও দুজনের মধ্যে একটা পার্থক্য তখনও ছিলই। অবশেষে গ্যালভানি তার আবিষ্কার সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির অবসানের লক্ষ্যে জীববিদ্যুৎ সম্পর্কে আরো বিশদ ব্যাখ্যা দিলেন।

১৭৯৪ সালে প্রকাশিত হলো তার আরেকটি বিখ্যাত থিসিস। এই থিসিসেই তিনি বলেন যে, জীবদেহে বিদ্যুৎ তৈরীর জন্য ধাতব আঘাতেরও কোন প্রয়োজন নেই। তিনি একটি ব্যাঙের নার্ভ দ্বারা অন্য একটি ব্যাঙের নার্ভে আঘাত করেও বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটিয়ে দেখিয়েছেন।

এইভাবে তিনি প্রমাণ করেন যে প্রাণীদেহের বিদ্যুৎ প্রাণীর শরীরে টিস্যুর মধ্যেই থাকে, তার জন্য বাইরের কোন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চালনার প্রয়োজন হয় না। ১৭৯০ সালে ৩০ জন তারিখে গ্যালভানির জীবনে ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা তার জীবনের এতোদিনের একনিষ্ঠ সহকর্মিনী সর্বক্ষণের সঙ্গিনী এবং জীবনসঙ্গিনী লুসিয়া নিঃসন্তান অবস্থায় ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

তার জীবনে এই সময় নেমে আসে আরও কিছু দুর্যোগ। এই সময় ইতালি দখল করে বসেন ফ্রান্স সম্রাট নেপোলিয়ন। কিন্তু গ্যালভানি নতুন দখলদার নেপোলিয়ন সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি দখলদা সরকারের কুনজরে পড়েন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার চাকরির পদেরও অবনতি ঘটানো হয়।

অতঃপর তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে যান দেশের বাড়িতে। সেখানে তখনো তার ভাই বাস করছিলেন।
পরে অবশ্য নতুন দখলদার সরকারের ভুল ভাঙ্গে। আবার তাকে সসম্মানে ডেকে পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কোনরকম কৈফিয়ত দান ও শর্ত ছাড়াই তাকে তার পদ ফিরিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু পুনরায় চাকরি ফিরে পাওয়ার পরও তার পক্ষে বেশিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ চাকরি ফিরে পেলেও শুরু হয় আরেক ধরনের উৎপাত। তারই কিছু সহকর্মী লেগে যায় তার পেছনে। তাকে যখন তখন প্রকাশ্যে অপমান করতে থাকে।

তাকে রাজদ্রোহী বলেও অপবাদ দেয়া হতে থাকে। ফলে তিনি আবার চাকরিতে ইস্তফা দেন। বাড়িতে এসে তিনি অসুখে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায়ও তার গবেষণা তিনি চালিয়ে যান। অতঃপর দেশের বাড়িতেই তিনি ৬১ বছর বয়সে ১৭৯৮ সালের ৪ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *