জীবনী: আল বেরুনী

আল বেরুনী

দশম শতাব্দীর শেষ এবং একাদশ শতাব্দীর যে সকল মনীষীর অবদানে পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল আল বেরুনী তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। জ্যোতিবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, গণিত।

দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন অগাধ পান্ডিত্বের অধিকারী। তিনিই সর্ব প্রথম প্রাচ্যের জ্ঞান বিজ্ঞান বিশেষ করে ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অধ্যাপক মাপা বলেন, “আল বেরুনী শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নয় বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি।”

তিনি পৃথিবীর ইতিহাস জগৎবাসীর সামনে রেখে গেছেন; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আত্মপরিচয় অনুপস্থিত। তার বাল্য জীবন, শিক্ষা জীবন, দাম্পত্য জীবন ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। সম্ভবত ঐতিহাসিকগণ ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তির বিস্তারিত পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

ইতিহাসের পাতা থেকে যতদূর জানা যায় ৩৬২ হিজরীর ৩ জিলহজ্জ মোতাবেক ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৩ সেপ্টেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার খাওয়ারিজমের শহরতলীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনী। তিনি নিজের নাম আবু রায়হান লিখতেন কিন্তু ইতিহাসে তিনি আল বিরুনী নামে অধিক পরিচয় হন।

তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল আল ইরাক বংশীয় রাজপতি বিশেষ করে আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরাকের তত্ত্বাবধানে। এখানে তিনি সুদীর্ঘ ২২ বছর রাজকীয় অনুগ্রহ করে কাটিয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালেই আস্তে আস্তে তার বিচিত্র প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বাসীয় বংশের খলিফাদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বহু স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব ঘটে।

এ সময় খাওয়ারিজম প্রদেশেও দুটি রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রদেশের দক্ষিণাংশে রাজত্ব করতেন আল বিরুনীর প্রতিপালক আল ইরাক বংশীয় আবু আব্দুল্লাহ এবং উত্তরাংশে রাজত্ব করতেন মামুন বিন মাহমুদ। ৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে মামুন বিন মাহমুদ আবু আব্দুল্লাহকে হত্যা করে রাজ্য দখল করে নিলে আল বিরুনীর জীবনে নেমে আসে দুঃখ দুর্দশা।

যাদের তত্ত্বাবধানে তিনি সুদীর্ঘ ২২টি বছর কাটিয়েছেন তাদেরকে হারিয়ে তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ত্যাগ করেন খাওয়ারিজম এবং চলতে থাকেন আশ্রয়হীন ও লক্ষ্যহীন পথ ধরে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত দিন কাটিয়েছেন অনাহারে অর্ধাহারে। এ সময় জুরজানের রাজা কাবুসের সুনজরে পড়েন তিনি। রাজা কাবুস ছিলেন বিদ্যুসাহী। জ্ঞানী ব্যক্তিদের তিনি খুব ভালবাসতেন।

তিনি ইতিপূর্বে আল বিরুনীর সুনাম শুনেছিলেন। রাজা আল বিরুনীর উন্নত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানের দিনগুলো আল বেরুনী সুখেই কাটিয়ে ছিলেন কিন্তু যাদের আদর স্নেহে তিনি ২২টি বছর কাটিয়েছিলেন সেই আল ইরাক বংশীয় অভিভাবকদের কথা ক্ষণিকের জন্যেও ভুলতে পারেননি।

এখানে অবস্থানকালে ১০০১-১০০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আসারুল বাকিয়া’ এবং ‘তাজরী দুশ শুয়াত’ নামক দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন সুরূপ তিনি ‘আসারুল বাকিয়া’ গ্রন্থটি রাজা কাবুসের নামে উৎস্বর্গ করেন। গজনীর দিগ্বিজয়ী সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তার শাহী দরবারে প্রায় প্রতিদিন দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে আলোচনা হত।

সুলতান মাহমুদের শাহী দরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে গজনীতে পাঠানোর জন্যে সুলতান মাহমুদ একটি সম্মানজনক পত্রে পরোক্ষ নির্দেশ দিয়ে পাঠান। পত্র পাবার পর আল বিরুনী কয়েকজন সঙ্গিনী নিয়ে ১০১৬ খ্রিস্টাব্দে গজনীতে সুলতান মাহমুদের শাহী দরবারে উপস্থিত হন। মাহমুদের দরবারে অন্যতম বিশ্বাস বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা এ প্রস্তাবকে অপমান ও আত্মমর্যাদাকে বিকিয়ে দেওয়ার সামিল আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন এবং কয়েকজন সংগীত নিয়ে খাওয়ারিজম ত্যাগ করেন।

সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে না পেয়ে এবং ইবনে সিনার বিদ্রোহের অজুহাতে খাওয়ারিজম রাজ্য দখল করে নেন। আল বিরুনী সুলতান মাহমুদের একান্ত সঙ্গে হিসাবে ১০১৬ হতে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত গজনীতে অবস্থান করেন। উল্লেখ্য যে, সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন এবং আল বিরুনী কয়েকবার সুলতানের সাথে ভারত এসেছিলেন।



তিনি তৎকালীন ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সমৃদ্ধি দেখে বিস্মিত হন। পরবর্তীতে রাজসর্মন নিয়ে ১০১৯-১০২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতে অবস্থান করে সেখানকার জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সঙ্গে ভূগোল, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে মতের আদান প্রদান করেন এবং সেখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন।

ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল হিন্দ’। তৎকালীন সময়ের ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় অনুশাসন জানার জন্যে এটি একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। অধ্যাপক হামারনেহের লিখেছেন,

“As a result of his profound and intimate knowledge of the country andits people, the author left us in his writing the wealth of information of undying interest on Civilization in the sub-continent during the first half at the eleventh century.”

আল বেরুনী ভারত থেকে গজনীতে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পরেই সুলতান মাহমুদ ইন্তেকাল করেন এবং তার পুত্র সুলতান মাসউদ ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। সুলতান মাসউদও আল বিরুনীকে খুব সম্মান করতেন। এই সময় আল বিরুনী রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কানুনে মাসউদী’। এ সুবিশাল গ্রন্থখানা সর্বমোট ১১ খণ্ডে সমাপ্ত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গ্রন্থটিতে আলোচনা করা হয়।

১ম ও ২য় খন্ডে আলোচনা করা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে; ৩য় খন্ডে ত্রিকোণমিতি; ৪র্থ খন্ডে- Spherical Astronomy; ৫ম খণ্ডে-গ্রহ, দ্রাঘিমা, চন্দ্র সূর্যের মাপ; ৬ষ্ঠ খন্ডে সূর্যের গতি; ৭ম খন্ডে চন্দ্রের গতি; ৮ম খন্ডে চন্দ্রের দৃশ্যমান ও গ্রহণ; ৯ম খন্ডে স্থির নক্ষত্র; ১০ম খন্ডে পাঁচটি গ্রহ নিয়ে এবং একাদশ খন্ডে আলোচনা করা হয়েছে জ্যোতিষ বিজ্ঞান সম্পর্কে।

এই অমূল্য গ্রন্থটি সুলতানের নামে নামকরণ করায় সুলতান মাসউদ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে আল বিরুনীকে বহু মূল্যবান রোপ্য সামগ্রী উপহার দেন। কিন্তু আল বিরুনী অর্থের লোভী ছিলেন না। তাই তিনি এ মূল্যবান উপহার সামগ্রী রাজকোষে জমা দিয়ে দেন। আল বেরুনী বহু জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতার ইতিহাস, মৃত্তিকা তত্ত্ব সাগর তত্ত্ব এবং আকাশ তত্ত্ব মানবজাতির জন্যে অবদান হিসেবে রেখে গেছেন।

ইউরোপীয় পণ্ডিত গানের মতে বেরুনী নিজেই বিশ্বকোষ। একজন ভাষাবিদ হিসেবেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। আরবি, ফারসি সিরিয়া গ্রীক, সংস্কৃতি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষার উপর ছিল তার পন্ডিত্য। ত্রিকোণমিতিতে তিনি বহু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। কোপার্নিকাস বলেছিলেন, পৃথিবীসহ গ্রহগুলো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অথচ ও কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর পূর্বেই আল বিরুনী বলেছেন, “বৃত্তিক গতিতে পৃথিবী ঘুরে।”

তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অংকের গণনায় ভুল ধরে দিয়ে তার সঠিক ধারণা দেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং আর্টিসীয় কূপের রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। জ্যােতিষ হিসেবেও তার প্রসিদ্ধ ছিল অত্যাধিক। তিনি যে সব ভবিষ্যৎ বাণী করতেন সেগুলো সঠিক হত। তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন।

তিনি এরিস্টটলের ‘হেভেন’ গ্রন্থের দশটি ভুল আবিষ্কার করেছিলেন। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কও তিনি আবিষ্কার করেন। সুক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনায় আল বিরুনী একটি বিস্ময়কর পন্থা আবিষ্কার করেন যার বর্তমান নাম The Formula of Intarpolation. পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ এটিকে নিউটনের আবিষ্কার বলে প্রচার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

অথচ নিউটনের জন্মের ৫৯২ বছর পূর্বেই আল-বেরুন একটি আবিষ্কার করেন এবং একে ব্যবহার করেন বিশুদ্ধ সাইন তালিকা প্রস্তুত করেন। এরপর ফর্মূলা পূর্ণতা দান করে তিনি একটি ট্যানজেন্ট তালিকাও তৈরি করেন। তিনিই বিভিন্ন প্রকার ফুলের পাপড়ি সংখ্যা হয় ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ১৮ হবে কিন্তু কখনো ৭ বা ৯ হবে না; এ সত্য আবিষ্কার করেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানও তার অবদান ছিল সর্বাধিক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি একটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থে তিনি বহু রোগের ঔষধ তৈরির কলা কৌশল বর্ণনা করেছেন। অধ্যাপক হামারনেহ বলেছেন, “শুধু মুসলিম জগতেই নয় পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জগতের মধ্যে আল বেরুনীই সর্ব প্রথম ব্যক্তি, যিনি খ্রিস্টপূর্বকাল থেকে তার সময়কাল পর্যন্ত ঔষধ তৈরি করার পদ্ধতি ও তার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *