জীবনী: টমাস আলভা এডিসন

টমাস আলভা এডিসন

প্রচলিত অর্থে বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝায় টমাস আলভা এডিসন সেই ধরনের বিজ্ঞানী নন। তিনি ছিলেন যন্ত্রবিদ, আধুনিক যন্ত্র সভ্যতায় প্রতিদিন আমরা যে সুফল অনুভব করছি প্রকৃতপক্ষে তিনি তার পথিকৃৎ।
তার আবিষ্কৃত প্রতিটি যন্ত্রটি আজ মানব জীবনের সাথে একাত্মা হয়ে আছে।

তাদের বাদ দিয়ে আমরা আমাদের জীবনের অস্তিত্ব ও কল্পনা করতে পারি না। যখনই আমরা কোন ইলেকট্রিক লাইট জ্বালাই, টেলিফোন তুলে অন্যের সাথে কথা বলি, কিম্বা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখি, তখন কল্পনাও করতে পারি না এই সমস্তই একজন মানুষের সৃষ্টি।

গত শতাব্দীতে যে যান্ত্রিক সভ্যতার সূচনা হয়েছিল, এডিসনকে বলা যেতে পারে সেই সভ্যতার জনক। এডিসনের জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি কানাডার মিলানে। তার পিতা ছিলেন ওলন্দাজ বংশোদ্ভুত। কয়েক পুরুষ আগে এডিসন পরিবার হল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় এসে আশ্রয় নেন।

কিছুদিন পর তারা আমেরিকা ত্যাগ করে কানাডায় এসে বসবাস শুরু করেন। এডিসনের পিতার আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ছেলেবেলার দিনগুলি আনন্দেই কেটেছিল। সাত বছর বয়সে এডিসনের পিতা মিচিগানের অন্তর্গত পোর্ট হারান নামে একটি শহরে নতুন করে বসবাস শুরু করেন।

এখানে এসেই স্কুলে ভর্তি হলেন এডিসন। ছেলেবেলা থেকে অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি। কিন্তু স্কুলের বাঁধা পাঠ্যসূচি তার কাছে খুবই ক্লান্তিকর মনে হত। তাই ক্লাসে ছিলেন সকলের পেছনের ছাত্র। ক্লাসে বসে খোলা জানালা দিয়ে বাইরের মুক্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে প্রায় আনমনা হয়ে যেতেন।

শিক্ষকরা অভিযোগ করতেন, এ ছেলের পড়াশুনায় কোন মন নেই। শিক্ষকদের কথা শুনে মনে মনে ক্ষুব্ধ হতেন এডিসনের মা। ছোট ছেলের প্রতি তার বরাবরই দুর্বলতা ছিল। তার মনে হতো এই ছেলে একদিন বিখ্যাত হবেই। স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনলেন এডিসনকে। শেষ হল এডিসনে তিন মাসের স্কুল জীবন।

এর পরবর্তীকালে আর কোনদিন স্কুলে যাননি। এডিসন মায়ের কাছেই শুরু করল তার পড়াশুনা। ছেলেবেলা থেকে এডিসনের ঝোঁক ছিল পারিপার্শ্বিক যা কিছু আছে, যা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বার করতে পারেন কিনা দেখবার জন্য ঘরের এক কোণে ডিম সাজিয়ে বসে পড়লেন।

কয়েক বছর পর কিশোর এডিসন পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার জন্য একটা ছোট ল্যাবরেটরি তৈরি করে ফেললেন তার বাড়ির একটা ঘরে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বলতে ছিল কিছু ভাঙ্গা বাক্স, কিছু শিশি বোতল, ফেলে দেয়া কিছু লোহার তার, আর এখানে ওখান থেকে কুড়িয়ে আনা যন্ত্রপাতির টুকরো।

অল্প কিছুদিন যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন হাতে কলমে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি আর নানান জিনিসপত্রের। বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অর্থ ছাড়া তো কোন পরীক্ষার কাজই চালানো সম্ভব নয়। এডিসন স্থির করলেন তিনি কাজ করে অর্থ সংগ্রহ করবেন। তেরো বছরের ছেলে চাকরি করবে!

বাবা-মা দুজনেই তো অবাক। কিন্তু এডিসন জেদ ধরে রইলেন, একগুঁয়ে ছেলে একবার যা স্থির করবে কোনভাবেই তার নড়চড় হবে না। অগত্যা মত দিতে হল এডিসনের বাবা-মাকে। কিন্তু তেরো বছরের ছেলেকে কাজ দেবে কে? অনেক খোঁজাখুঁজির পর খবরের কাগজ ফেরি করার কাজ পাওয়া গেল।

ট্রেনে পোর্ট হুরোন ষ্টেশন থেকে ড্রেট্রয়েট স্টেশনের মধ্যে যাত্রীদের কাছে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হবে। বিক্রির উপর কমিশন। আরো কিছু বেশি আয় করবার জন্য এডিসন খবরের কাগজের সাথে চকলেট বাদামও রেখে দিতেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু অর্থ সংগ্রহ করে ফেললেন।

এই সময় এডিসন সংবাদ পেলেন একটি ছোট ছাপাখানা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সামান্য যে অর্থ জমিয়েছিলেন তাই দিয়ে ছাপাখানার যন্ত্রপাতি কিনে ফেললেন, এবার নিজেই একটি পত্রিকা বার করে ফেললেন। সংবাদ জোগাড় করা, সম্পাদনা করা, ছাপানো, বিক্রি করা, সমস্ত কাজ তিনি একাই করতেন।

অল্পদিনেই তার কাগজের বিক্রি সংখ্যা বেড়ে গেল। এক বছরের মধ্যে তার লাভ হলো একশো ডলার। তখন তার বয়স ১৫ বছর। স্টেশনে স্টেশনে ঘোরাঘুরি করতে করতে অনেক রেল কর্মচারীর সাথে আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বিষয়েই ছিল তার অদম্য কৌতুহল। একদিন এডিসন মাউন্ট ক্লিসেন্স স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় তার চোখে পড়ল একটি ছেলে লাইনের উপর খেলা করছে।



দূরে একটি ওয়াগন এগিয়ে আসছে। ছেলেটির সেদিকে নজর নেই। আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে হাতের কাগজ ফেলে দিয়ে এডিসন ঝাঁপিয়ে পড়লেন লাইনের উপর। ছেলেটিকে তুলে নিয়ে লাইন থেকে নিচে নেমে এলেন। ছেলেটি স্টেশনমাস্টারের একমাত্র পুত্র।

কৃতজ্ঞ স্টেশনমাস্টার যখন এডিসনকে পুরস্কার দিতে চাইলেন, এডিসন টেলিগ্রাফি শেখবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সানন্দে রাজি হলেন স্টেশনমাস্টার। কয়েক মাসের মধ্যে নিজের অসাধারণ মেধায় মোটামুটিভাবে টেলিগ্রাফি শিখে নিলেন, সেই সঙ্গে সাংকেতিক লিপি ও তার অর্থ বুঝে নিতে সক্ষম হলেন।

স্টেশন আর রেলগাড়ি হয়ে উঠল এডিসনের ঘর সংসার। এখানেই তার দিন রাতের বেশিরভাগ সময় কাটত। নিজের ইচ্ছাকে পুরোপুরি কাজে লাগাবার জন্য ট্রেনের মাল রাখবার একটি ছোট ল্যাবরেটরি গড়ে তুললেন। কাগজ বিক্রির ফাকে যতটুকু সময় পেতেন এখানে গবেষণার কাজ করতেন।

একদিন চলন্ত ট্রেনে তার হাত থেকে টুকরো আগুন ছিটকে পড়ল কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে। সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠল। বহু কষ্টে আগুন নেভানো হল। কিন্তু কন্টাকটার রাগে ফেটে পড়ল। পরের স্টেশনে আসতেই ল্যাবরেটরির সব জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে এডিসনের কানের উপর এক ঘুষি মেরে থাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলেন।

সেই আঘাতের ফলেই সমস্ত জীবন কানে কম শুনতে এডিসন। এইবার শুরু হলো তার নতুন এক জীবন। স্টাফোর্ড জংশনে রাত্রিবেলায় ট্রেনের ছাড়বার সিগনাল দেওয়ার কাজ পেলেন। রাত জেগে কাজ করতে হত আর দিনের বেলা সামান্য কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে নিজে তৈরি করলেন যেটি আপনার থেকে নির্দিষ্ট সময় সিগনাল দিত। এক জায়গায় বেশি দিন কাজ করবার অভ্যাস ছিল না এডিসনের।

বোস্টন শহরে টেলিগ্রাফ অফিসে অপারেটরের কাজ নিলেন। কিন্তু প্রচলিত কলাকৌশলে কখনো সন্তুষ্ট হতেন না এডিসন। প্রতিমুহূর্তে তিনি চিন্তা করতেন নতুন কোন কৌশল উদ্ভাবন করতে যা আরো বেশি উন্নত আর সহজ। এডিসন যেখানে চাকরি করতেন সেই অফিস জুড়ে ইঁদুরের ভীষণ উৎপাত।

মাঝে মাঝেই তারা যন্ত্রপাতির মধ্যে ঢুকে পড়ে কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটাত। এডিসন একটি যন্ত্র বার করলেন যাতে সহজেই ইঁদুরের ধ্বংস করা যায়। এছাড়াও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আরো কিছু যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করলেন। কিন্তু তাতে কারোই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেন না।

১৮৬৯ সালে যখন তিনি বোস্টনে চাকরি করছেন তখন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন যা দিয়ে ভোল্ট গণনা করা যায়। এই যন্ত্রের পেমেন্ট পাবার জন্য তিনি আবেদন করলেন। এই যন্ত্রের গুনাগুন বিবেচনা করে উদ্ভাবক হিসাবে তাকে পেমেন্ট দেওয়া হল। এই পেমেন্ট এডিসনের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

তিনি স্থির করলেন যা কিছু প্রত্যক্ষভাবে মানুষের ব্যবহার্য হিসেবে গণ্য হয়, শুধুমাত্র তেমন জিনিসেই তৈরি করবেন। সমস্ত জীবনই তিনি এই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছেন বোস্টন শহর আর ভাল লাগছিল না। সেখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে এলেন নিউইয়র্কে। হাতে একটি পয়সা নেই, দুদিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি।

কোথাও যাবেন, কি করবেন কিছুই জানেন না। এমন সময় আলাপ হল এক অল্পবয়সী টেলিগ্রাফ অপারেটরের সাথে। সে এডিসনকে এক ডলার ধার দিয়ে গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানির ব্যাটারির ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। দু’দিন সেখানে কেটে গেল।

তৃতীয় দিন এডিসনের নজর পড়ল অফিসের ট্রানসমিটারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। অফিসের ম্যানেজার, কর্মচারীরা বহু চেষ্টা করেও যন্ত্রটি ঠিক করতে পারছেন না। কিছুক্ষণ লক্ষ্য করতেই যন্ত্রটির খারাপ হওয়ার কারণ বুঝতে অসুবিধা হলো না এডিসনের। ম্যানেজারের অনুমতি নিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে ট্রানসমিটারটি ঠিক করে দিলেন।

ম্যানেজার খুশি হয়ে তখনই তাকে কারখানার ফোরম্যান হিসাবে চাকরি দিলেন। তার মাইনে ঠিক হল ৩০০ ডলার। কিছু দিনের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় ম্যানেজার পদে উন্নীত হলেন। এডিসন মেরি নামে একটি মেয়েকে বিবাহ করেন। মেরি শুধু এডিসনের স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন তার যোগ্য সহধর্মিনী।

এডিসনের সাফল্যের পেছনে তার ভূমিকাও কম নয়। ১৮৮৪ সালে মেরির মৃত্যু হয়। তখন তিনি তিন সন্তানের জননী। মেরির মৃত্যুর দু’বছর এডিসন মিনা মিলারকে বিবাহ করেন, কিন্তু জীবনের এই পর্বে তার সৃজনীশক্তি আশ্চর্যজনকভাবে হ্রাস পেয়েছিল।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Comment