জীবনী: কনরাড রঞ্জন

কনরাড রঞ্জন

জীবনী: কনরাড রঞ্জন চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে এক্স-রে আজ একটি বড় বিষয়। শরীরের মধ্যেকার অনেক কিছু জানার জন্যই এক্স-রে উত্তম পন্থ। সারা পৃথিবী জুড়েই আজ চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এক্স-রে পদ্ধতি।

রোগ নির্ণয়ের এই আধুনিক বিস্ময়কর পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেম কনরাড রনজেন। এটি একটি বিস্ময়কর অদৃশ্য আলোবিশেষ, যে অদৃশ্য আলো শরীরের চামড়া-মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে প্রতিফলিত হয়। তুলে আনে হাড়ের ছবি। ফলে শরীরের মধ্যকার কোন অংশে কি রোগের সৃষ্টি হয়েছে তার ছবি ধরা পড়ে চোখের সামনে।

আর সেই ছবি দেখেই সহজে চিকিৎসকগণ রোগনির্ণয় করতে পারেন। অধ্যাপক রনজেন এ বিস্ময়কর আলোটি আবিষ্কার করেন ৫০ বছর বয়সে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। আলো এবং বিদ্যুৎ নিয়ে অন্য একটি পরীক্ষা চালানোর সময়েই নিতান্ত আকস্মিকভাবেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন এই বিস্ময়কর আলোটি।

অদৃশ্য আলোটি আবিষ্কারের পর তিনি নিজেও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও তখন বুঝতে পারেননি এই রহস্যময় আলোটি কোথা থেকে আসে বা এর মূল উৎস কোথায়। এটি কিসের আলো তার কিছুই বুঝে না ওঠার কারণে তিনিও এর সঠিক কোনো নাম কিংবা চরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারেননি। বীজগণিতের কায়দায় ‍দিয়েছিলেন একটি আনুমানিক নাম।

বীজগণিতে আনুমানিক কোনো সংখ্যা বা বস্তু বোঝাতে যেমন একটি করে ইংরেজি অক্ষর অর্থাৎ X, Y ব্যবহার করা হয়, তেমনি তিনিও অজানা রহস্যময় এই আলোকের আনুমানিকভাবে নাম রেখেছিলেন এক্স আলো। যার উৎস এখনো জানা যায়নি, তেমনি একটি আলো। প্রকৃত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়নি বলেই আপাতত নাম রাখা হলো X আলো বা X-Ray.

সেই নামই আজো চলছে। পরবর্তীকালে এর অবশ্য আরো একটি নামকরণ হয়েছে। আবিষ্কর্তার নামানুসারেই এর নাম রাখা হয়েছে রঞ্জনরশ্মি। অর্থাৎ বিজ্ঞানী রনজেন আবিষ্কৃত আলো- তাই রঞ্জনরশ্মি। দুটো নামই এখন সমানভাবে প্রচলিত। এই রহস্যময় রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে একটি মজার গল্প। আগেই বলেছি, এটি ছিলো বিজ্ঞান রনজেনের একটি আকস্মিক আবিষ্কার।

তিনি রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কারের জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। অন্য কিছু নিয়ে গবেষণা করার সময়েই বিস্ময়করভাবে এর সন্ধান পেয়ে যান। একদিন অধ্যাপক রনজেন তার নিজের গবেষণাগারে একটি একমুখ খোলা কাচের নল নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তিনি গ্যাসের বৈদ্যুতিক নিঃসরণ নিয়ে কি একটা যেনো পরীক্ষা করছিলেন। ঘরটা ছিলো সম্পূর্ণ অন্ধকার।

কাচের নলটি থেকে যতোটা সম্ভব বাতাস বের করে নেয়া হয়েছে এবং তার দু’মাথায় তিনি জুড়ে দিলেন দুটো তারের টুকরো। এদের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলেন। নলের ভেতর দিয়ে বয়ে যায় বিদ্যুতের কণা। তিনি দেখলেন, কাছের একটা ফটোগ্রাফের প্লেট কেমন যেনো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধুৃ তাই নয়।

সেদিন এক মজার কাণ্ডও ঘটলো। রনজেন ঐ প্লেটগুলোকে ডেভলপ করতে গিয়ে দেখলেন, তার একটাতে রয়েছে একটি চাবির ছবি। চাবিটা টেবিলের উপর ছিলো। তারই ছবি উঠেছে প্লেটের গায়ে। তিনি কিন্তু ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে লাগলেন খুব। কারণ এমনটা হবার কথা নয়। তিনি ভাবতে লাগলেন, নলের গা দিয়ে যে আলো বেরুচ্ছে, তার জন্যই হয়তো প্লেটগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে এবং চাবির ভেতর দিয়ে সে আলো যেতে পারেনি বলেই তার ছবি উঠেছে প্লেটে।



তিনি এখন কালো কগজ দিয়ে ঢেকে দিলেন নলটাকে, কিন্তু দেখলেন তাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। প্লেট যেমন ঝাপসা হচ্ছিল, তেমনি ঝাপসা হয়ে গেলো আবারো। রনজেন বুঝলেন, নিশ্চয়ই এমন একটি আশ্চর্য আলোর সৃষ্টি হচ্ছে যা চোখে দেখা যায় না, আর যাকে সাধারণ আলোর মতো কালো কাগজও আটকে রাখতে পারছে না।

বীজগণিতের অজানা সংখ্যাকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয় এক্স। রনজেনও তাই এই অজানা আলোর নাম দিলেন এক্স-রে। এই মজার আলো আবিষ্কার করার পর তিনি নিজেই তার অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে লাগলেন। এবার তিনি তার স্ত্রীর একটি হাত নিয়ে রাখলেন ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর। তারপর এর মধ্য দিয়ে এক্স-রে আলো প্রবাহিত করলেন।

পরে ফটোগ্রাফিক প্লেটটি ডেভেলপ করার পর তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন- প্লেটে তার স্ত্রীর হাতের ভেতরকার শুধু হাড়ের ছবি উঠেছে। মাংসগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। রনজেনের স্ত্রীর হাতে ছিলো একটি সোনার আংটি। দেখা গেলো সেই সোনার আংটির ছবিও এসেছে। এটাই হলো বিশ্বের সর্বপ্রথম জীবিত প্রাণীর কঙ্কালের ছবি এবং প্রথম এক্স-রে।

এই আবিষ্কারের সাথে সাথেই ডাক্তাররা একে কাজে লাগাতে লাগলেন। কারণ দেহের অদৃশ্য জায়গার ছবি তুলতে এর জুড়ি নেই। দাঁতের গোড়ার ঘা, ভাঙা হাড় বা বুকের ভেতর যক্ষ্মা বা অন্য কোনো রোগ, অন্ত্রের ঘা, বৃক্কের বা মুত্রাশয়ের রোগের কারণ এতদিনে বোঝা যেতো না, তা এখন থেকে এক্স-রে ছাবি তুলে বোঝা যেতে লাগলো। ডাক্তারেরা দেখলেন, এক্স-রে খুব সহজ আলো নয়।

এর আরো অনেক গুণ আছে। দেহের ভেতর যেসব তন্তু নতুন করে গড়ে উঠেছে, এক্স-রে দিয়ে তাদের নষ্ট করে দিতে পারে। ক্যান্সারের কোষগুলোও তরুণ কোষ, আর সেজন্য বাড়েও ভীষণ তাড়াতাড়ি। কাজেই এক্স-রে দিয়ে এদের মেরে ফেলা যায় কি না চলতে লাগলো তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দেখা গেলো সত্যিই খুব শক্তিশালী এক্স-রে দিয়ে তাদের ধ্বংস করা যায়। ক্যান্সার কাবু করা সম্ভব এক্স-রে দিয়ে।

এক্স-রের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী উইলহেম কনরাড রনজেনের জন্ম হয়েছিলো জার্মানের লেন্নেপ শহরে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ। তিনি বিয়ে করেছিলেন হল্যান্ডের জনৈকা সুন্দরী মহিলাকে। রনজেনের বাল্যকাল মামার বাড়িতে কেটেছিল। হল্যান্ডে থেকেই লেখাপড়াও করেছিলেন তিনি। পরে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য আসেন সুইজারল্যান্ডে। ভর্তি হন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন থেকে তিনি ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৪ বছর বয়সে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন।

এরপর শুরু হয় তার কর্মজীবন। তিনি পর পর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন জার্মানের উয়িরজবার্গ বিশ্ববিদ্যায়ে। এখানে তিনি আবিষ্কার করেন এক্স-রে। আবিষ্কারের পরও তিনি আরো দীর্ঘদিন এই এক্স-রে রশ্মির উপর গবেষণা করেন এবং তার অনেক বিস্ময়কর ক্ষমতার সন্ধান লাভ করেন।

তিনি দেখলেন, শরীরের ভেতরকার বিভিন্ন অংশের ছবি তোলা ছাড়াও এই আলো আরো অনেক কিছু রহস্যের সমাধান দিতে পারে। এই এক্স-রে আলো প্রাকৃতিক হীরা আর নকল হীরার পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। এর দ্বারা হীরার ভেতরকার স্ফটিকের গঠন-বৈশিষ্ট্যের ছবি তোলা যায়, যার দ্বারা আসল-নকল সনাক্ত করা সম্ভব।

ফলে হীরা ব্যবসায়ীদের কাছে এই আলোর কদর বেড়ে যায়। এ ছাড়া কোনো লৌহরডের কোথাও যদি ফাটল বা দুর্বল অংশ থাকে, সেখানেও এই এক্স-রে আলো ফেলে তার ভেতরকার দুর্বল অংশের ছবি তোলা যায়। এই এক্স-রে শুধু চিকিৎসাশাস্ত্র নয়, আরো অনেক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আছে।বিজ্ঞানী রনজেন শুধু এক্স-রে নিয়েই গবেষণা করেননি, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও তার অবদান আছে।

তিনি পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা ও তরল পদার্থের অণুর আকর্ষণ-বিকর্ষণের উপরেও গবেষণা করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রকমের গ্যাসের তাপমাত্রা, স্ফটিকের গায়ে উত্তাপ দিলে কি প্রতিক্রিয়া ঘটে, গ্যাসের তাপ শোষণ ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়েও তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং আবিষ্কার করেছেন অনেক নতুন নতুন তত্ত্ব।

ঊনবিংশ শতকের একেবারে শেষের দিকে তিনি চলে আসেন মিউনিকে এবং মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এখানেই তিনি ৭৮ বছর বয়সে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে পরলোক গমন করেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Comment