জীবনী: এন্টনি লরেন্ট ল্যাভয়সিয়ে

এন্টনি লরেন্ট ল্যাভয়সিয়ে

১৭৪৩ সালের ২৬শে আগস্ট ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার জন্মগ্রহণ করেন এন্টনি লরেন্ট ল্যাভয়সিয়ে । পিতা ছিলেন পার্লামেন্টের এটর্নি। তার পূর্বপুরুষেরা অবশ্য ছিলেন রাজ পরিবারের ঘোড়াশালার কর্মচারী। নিজের চেষ্টায় পরিশ্রমে ল্যাভোশিঁয়ের পিতা নিজেকে প্যারিসের সম্ভ্রান্ত মহলে প্রতিষ্ঠিত করেন।

পিতার ইচ্ছা ছিল তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইনের ব্যবসায় যুক্ত হবে। ১১ বছর বয়সে তাকে শিক্ষায়তনে ভর্তি করে দেওয়া হল। জন্ম থেকেই ল্যাভোশিঁয়ে অন্যসব বিষয়ের মধ্যে বিজ্ঞানই ল্যাভোশিঁয়েকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত। স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হলেন।

এখানে তার শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত অংকবিদ ও জ্যোতির্বিদ নিকোলাস লুইস। অল্পদিনেই দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। গুরু শিষ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। নিকোলাস আবহবিদ্যার প্রতি ল্যাভয়সিয়েকে আকৃষ্ট করে তোলেন। তারই ফলে সমস্ত জীবন আবহবিদ্যার প্রতি ল্যাভয়সিয়ের ছিল গভীর অনুরাগ।

এই সময় পিতার ইচ্ছা অনুসারে আইনের ক্লাসে ভর্তি হলেন। আইনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আইনের প্রতি তার সামান্যতম আকর্ষণ ছিল না। দিন রাত অধিকাংশ সময় তার কেটে যেত বিজ্ঞান চর্চায়। বাড়িতেই ছোট একটি গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন তিনি।

বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে গবেষণাতেই ডুবে থাকতেন ল্যাভয়সিয়ে। এই সময় (১৭৬৪ সালে) তিনি ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে প্রথম তার বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা পড়লেন। তাতে মৌলিক কোন তথ্য না থাকলেও তার প্রচেষ্টার সকলেই প্রশংসা করল। পরের বছর ফরাসি একাডেমীর পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল।

রচনার বিষয় ছিল “পথে কিভাবে আলো দেওয়া সম্ভব এবং তার সমস্যা”। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন ল্যাভোশিঁয়ে। অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের সাথে পরিচয় হল ল্যাভয়সিয়ের। এদের মধ্যে ছিলেন ভূ-তত্ত্ববিদ জিন গুটার্ড। গুটার্ড সেই সময় ফরাসি দেশের ভূতত্ত্ব বিষয়ক মানচিত্র তৈরীর কাজে তার সঙ্গী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

এই কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমন করতে হবে জেনে সানন্দে নিজের সম্মতি জানালেন। ১৭৬৭ সালে মানচিত্র তৈরীর কাজে বেরিয়ে পড়লেন ল্যাভোশিঁয়ে। কাছে আছে মাত্র ৫০ লুইস। সঙ্গী বলতে একটি ঘোড়া, চাকর জোফেস আর প্রৌঢ় বিজ্ঞানী গুটার্ড। দুজনের মনেই অদম্য সাহস আর অজানাকে জানবার তীব্র কৌতুহল।

নির্জন প্রান্তর পাহাড় নদী পথ ধরে দুজনে ঘুরে বেড়ালেন ফ্রান্সের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে শুধু মুগ্ধ হন না ল্যাভয়সিয়ে, তার অপার রহস্য তার মনকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে উঠে থার্মোমিটার ব্যারোমিটার দেখা। তারপর মাটির রং, তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা।

যেখানে রয়েছে খনিজ সম্পদ তার সম্ভাব্য পরিমাণ বিস্তৃতি নিরূপণ করা, নদীর গতিপথ হ্রদ ঝর্ণার অবস্থা, বিভিন্ন ধরনের গাছপালা তাদের বর্ণনা। নিখুঁতভাবে খাতার পাতায় লিখে রাখতে হয়। কয়েক মাস বিস্তৃত পর্যবেক্ষণের পর তারা ফিরে এলেন প্যারিসে।

এই দেশভ্রমণের ফলে একদিকে ল্যাভোশিঁয়ে এর মধ্যে গড়ে উঠল নতুন জীবন দর্শন, বিশ্বপ্রকৃতিকে আরো গভীর ব্যাপকভাবে চেনবার ক্ষমতা, অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রমের ক্ষমতা। প্যারিসে ফিরে এসে স্থির করলেন আইন নয়, বিজ্ঞানই হবে তার জীবন সাথী। কিছুটা আশাহীন ভাবেই ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করলেন।

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন জানতে পারলেন তাকে বিজ্ঞান একাডেমীর সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। এক তরুণের পক্ষে এই অভাবনীয় গৌরব। শুরু হল তার গবেষণা একাডেমীর প্রত্যেক সদস্যকে নিয়মিত গবেষণা, একাডেমীর প্রত্যেক সদস্যকেই নিয়মিত গবেষণা পত্র জমা দিতে হত।

গবেষণার বিষয় ছিল যেমন বিচিত্র তেমনি ব্যাপক। জীবদেহের উপর চুম্বকত্বরে প্রভাব, অভিকর্ষ, জল সরবরাহ, রঙ্গের তত্ত্ব, বাঁকাকপির বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন, চিনি তৈরি করা, কয়লা থেকে পিচ তৈরি করা, কীটপতঙ্গের শ্বাস-প্রশ্বাস।

এই বিচিত্র ধরনের গবেষণা করে যখন অন্যেরা সমস্ত দিন সামান্যতম সময় পেতেন না, ল্যাভয়সিয়ে অন্য সকলের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেও একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল “Ferme”। এদের কাজ ছিল সরকারকে হিসাব মত রাজস্ব জমা দেওয়া।



বিনিময়ে তারা চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। খাজনার পরিমাণ রাজস্বের চেয়ে যত বেশি হত ততই “Ferme”- এর লাভ। ল্যাভোশিঁয়ে বুঝতে পারছিলেন গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই তিনি খাজনা সংগ্রহের চাকরি নিলেন।

যে বিজ্ঞানের সাধনার জন্য তিনি অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন সেই অর্থই একদিন তার মৃত্যুর কারণ হল। Ferme-তে দু বছর চাকরি করবার পর ল্যাভয়সিয়ে তার এক উচ্চপদস্থ মনিবের সুনজরে পড়ে গেলেন। তার একমাত্র মেয়ে মেরী এ্যানির সাথে ল্যাভোশিঁয়ের বিবাহ দিলেন।

মেরী তখন মাত্র ১৪ বছরের বালিকা। পরবর্তী জীবনে মেরী হয়ে উঠেছিলেন ল্যাভয়সিয়ের যোগ্য সঙ্গিনী। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে নানাভাবে সাহায্য করতেন। বিভিন্ন ইংরেজি প্রবন্ধ ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন। ল্যাবরেটরির কাজের বিভিন্ন সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে দিতেন।

কখনো নোট তৈরি করতে সাহায্য করতেন। শ্বশুরের সাহায্যে চাকরিতে ক্রমশ উন্নতি করছিলেন ল্যাভয়সিয়ে। কাজের চাপ বাড়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তার সময় নির্দিষ্ট ছিল সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত, সন্ধ্যাবেলায় সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত।

গবেষণা কাজের জন্য বিরাট একটি ল্যাবরেটরি তৈরি করলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করলেন সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। কিছু দক্ষ সহযোগীকে নিযুক্ত করলেন। গবেষণার জন্য তার মতো তরুণ বিজ্ঞানীদের কাছে ল্যাবরেটরির জন্য যে বিরাট পরিমাণ অর্থ ব্যয় হত, সবটাই দিতেন ল্যাভোশিঁয়ে, প্রকৃতপক্ষে তার আয়ের প্রায় সবটুকুই এখানে ব্যয় করতেন।

ব্যয় বাহুল্যের জন্য তাকে নিয়ে লোকে কৌতুক করত, অর্থ খরচের পরীক্ষাগার। এই অর্থ খরচের গবেষণার থেকেই একদিন জন্ম নিল এক বিজ্ঞান যা জ্ঞানের জগতে নতুন আলোক শিখা জ্বালিয়ে দিল। অ্যালকেমির কুয়াশাচ্ছন্ন জগতে আবির্ভূত হল আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞান।

ল্যাভোশিঁয়ে যখন গবেষণা আরম্ভ করেছিলেন তখন রসায়ন মধ্যযুগীর এক বিচিত্র চিন্তাভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রসায়নকে বিবেচনা করা হত শুধুমাত্র চিকিৎসার সহায়ক হিসেবে। লন্ডন গেজেটে প্রকাশিত একটি বিবরণ থেকে জানা যায় মিসেস স্টীফেন নামে এক ব্রিটিশ রসায়নবিদ একটি ঔষধ তৈরি করেছেন যা দিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পেটের পাথুরি সারানো সম্ভব হয়েছে।

ঔষধটি তৈরি হয়েছে ডিমের খোলা, গুগলি, সাবানের দলা, আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া, শাক, আর মধু একসাথে মিশিয়ে। এই বিচিত্র ঔষধ তৈরির জন্য মিসেস স্টীফেন পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার পেয়েছিলেন। অন্য আর একজন রসায়নবিদ পরীক্ষা করে সর্ব-সম্মুখে দেখালেন একটি বস্তুকে অন্য আর একটি বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়। একটি পাত্রে জল নিয়ে ফুটাতে আরম্ভ করা হল।

পাত্রের মুখ যথাসম্ভব ঢেকে দেওয়া হল। সমস্ত জল বাষ্প হয়ে বার হবার পর দেখা গেল পাত্রের মধ্যে খানিকটা মাটির মতো গুঁড়ো পড়ে রয়েছে। রসায়নবিদ বললেন, এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে জল থেকে সৃষ্টি হয় মাটি। এ ঘটনাই প্রথম ল্যাভোশিঁয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

প্রকৃতপক্ষে এর সূত্রপাত যখন তিনি গুটার্ড-এর সাথে মানচিত্র তৈরির কাজে দেশ ভ্রমণ করছিলেন। তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন জলের ঘনত্ব, তার প্রকৃতি। তার মনে সন্দেহ দেখা দিল সত্যিই কি জলের অবশিষ্ট অংশ মাটির না পাত্রের ভগ্নাবশেষ?

শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে কোন কিছুই বিশ্বাস করতে চাননি ল্যাভয়সিয়ে। তিনি যুক্তি প্রমাণ পরীক্ষার সাহায্যে সত্যকে নিরূপণ করতে চাইলেন। এই নিরূপিত সত্য এ্যালকেমি সম্বন্ধে বহু যুগের প্রচলিত বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করল। ল্যাভোশিঁয়ে এখানেই থেমে গেলেন না।

তিনি বললেন, জলই পরিবর্তিত হয়ে জন্ম দেয় গাছের এই ধারণা ভ্রান্ত। গাছ বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রণ। এই সমস্ত পদার্থ গাছ গ্রহণ করে মাটি থেকে, জল থেকে, বাতাস থেকে। প্রকৃতপক্ষে এই বই আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তকে উন্মোচিত করল। কিন্তু একদল প্রাচীনপন্থী মানুষ মুখর হয়ে উঠল এর বিরুদ্ধে, ‍‍“এই বইয়ের সমস্তই অবাস্তব ধারণনার উপর গড়ে উঠেছে। যা কিছু নতুন তাই সত্য নয়। আবার যা কিছু সত্য তাই নতুন নয়।”



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *