জীবনী: নিকোলাস কোপার্নিকাস

নিকোলাস কোপার্নিকাস

জীবনী: নিকোলাস কোপার্নিকাস সভ্যতার আদি যুগ থেকে মাটির মানুষ বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে থাকতো আকাশের দিকে। আকাশের চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা সব কিছুই তার কাছে ছিল অপার বিস্ময়ের। বিজ্ঞানের কোন চেতনা তখনো মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেনি। তাই অন্তত আকাশের মতই ছিল তার সীমাহীন কল্পনা।

ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে জ্ঞানের চেতনা। কত প্রশ্ন জেগে ওঠে তার মনে। এই বিশ্ব প্রকৃতির অপর রহস্য ভেদ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জিজ্ঞাসু মন আর এই জিজ্ঞাসা থেকেই শুরু হল অনুসন্ধান।

আকাশের রহস্যভেদের চর্চায় মানুষ কবে থেকে নিয়োজিত হল তার সঠিক কোন তারিখ নেই। তবে জ্যোতির বিজ্ঞানের চর্চা প্রথম শুরু হয়েছিল চীন দেশে। তবে তাদের উপলব্ধি বা গবেষণার বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিদরা প্রথম ঋতুর আবর্তন উপলব্ধি করে তারা এক বছর নির্ণয় করেন।

তাদের হিসাবে ছিল ৩৬০ দিনে এক বছর হয়। বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে প্রথম যে মানুষটি আলোর পথ দেখান তার নাম পিথাগোরাস। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত ইজিয়ান সাগরের বুকে সামস দ্বীপে তার জন্ম হয়। জ্ঞানের আকর্ষণে তিনি কিশোর বয়সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন।

নানান দেশের ভ্রমণ করেন মিশরে যান। সেখানকার পুরোহিতদের কাছে শিখেছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যামিতিশ্র। ইতালির ক্রোতনায় এসে তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুললেন। জ্ঞানের সাধনাতেই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

মূলত অংক শাস্ত্রবিদ হলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনিই প্রথম উল্লেখ করেছিলেন— এই পৃথিবী ও গ্রহ আপন অক্ষের চারিদিকে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু তার এই অভিমতকে কেউ গ্রহণ করেনি। তার পরে এলেন প্লেটো ও অ্যারিস্টোটল। মানুষের জ্ঞান চিন্তা ভাবনার জগতে এক নতুন দিগন্তের দ্বারকে উন্মোচন করলেন।

এর পাশাপাশি কিছু ধারণার কথা প্রকাশ করলেন যা মানুষের জ্ঞানের জগতে অন্ধকার যুগ নিয়ে এল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যারিস্টোটল কোন পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা ছাড়াই একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল পৃথিবী স্থির। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা একই পথে আবর্তিত হচ্ছে।

চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। তার এই মতবাদকে মানুষ অভ্রান্ত বলে মেনে নিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সালে অ্যারিস্টার্চ তার অভিমত প্রকাশ করেন যে সূর্যই এই সৌরমন্ডলের কেন্দ্রবিন্দু এবং স্থির। কিন্তু এই অভিমতকে সকলেই অগ্রাহ্য করল।

পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নানান তত্ত্ব উদ্ভাবন করলেন। তার এইসব তত্ত্বই উদ্ভাবন করলেন। তার এই সব তত্ত্বগুলিই ছিল ভুল। তিনি বললেন বিশ্ব একটা গোলক এবং তা গোলকের মতই ঘুরছে। পৃথিবীও একটি গোলাকার বস্তু এবং তা বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।

পৃথিবী স্থির, সূর্যই তার চারিদিকে ঘুরছে। তার এই অভিমতের স্বপক্ষে একটি মানচিত্রও অঙ্কন করেন। অ্যারিস্টোটল ও টলেমির এই সব তত্ত্ব ও সূত্রগুলি প্রায় ১৪০০ বছর ধরে মানুষ অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নিয়েছে। কেউ তার ভুল ভ্রান্তি নিরূপণ করার চেষ্টা করেনি।

যীশুর জন্মের পরবর্তীকালে যখন বাইবেল রচিত হল, বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য সম্বন্ধে বাইবেলের রচনাকারদের সামনে টলেমির সিদ্ধান্তগুলোই বর্তমান ছিল। তাই তারা সেই সব অভিমতকেই বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। অল্প দিনের মধ্যে তা ধর্মের অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হল।

পরবর্তীকালে মানুষ বাইবেলের প্রতিটি কথাকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিল। কারোর মনে ছিল না কোন সংশয় বা জিজ্ঞাসা। এমনকি বৈজ্ঞানিকরাও বাইবেলকে অভ্রান্ত বলে মেনে নিল। এর পেছনে আরো একটি কারণ ছিল ইউরোপের বুকে তখন চার্চের অপ্রতিহত প্রতাপ। একজন সম্রাটের মতই ছিল পোপের ক্ষমতা।

অর্থ সম্পদ লোকজন কোন কিছুই কম ছিল না। একটি চার্চ হয়ে উঠেছিল ক্ষমতা, ভন্ডামি আর সন্ত্রাসের কেন্দ্রভূমি। যেসব বিজ্ঞানী পন্ডিতরা চার্চ এবং বাইবেলকে মেনে চলত, তাদের নানাভাবে সাহায্য করা হত। কিন্তু যদি কখনো কেউ চার্চ বা বাইবেলের বিরোধী একটি শব্দও উচ্চারণ করত তখন তাকে কঠোর হাতে দমন করা হত।



কারাগারে পাঠানো হত, নয়ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। ধর্মের আজ্ঞাবহ হয়ে বিজ্ঞান এক অন্ধকার যুগেই পড়ে ছিল। এই অন্ধকারের মধ্যেই অল্প কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এলেন। তারা মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে, ধর্মের বন্ধনকে ছিন্ন করে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন সত্যকে। তাদের আবিষ্কৃত সত্যের আলোয় বিজ্ঞান নতুন পথে সন্ধান পেল।

এইসব মহান বিজ্ঞানীদের অগ্র ও পথিক যিনি তার নাম নিকোলাস কোপার্নিকাস। ১৪৭৩ সালে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ডের থর্ন শহরে কোপার্নিকাসের জন্ম। থর্ন বাল্টিক সাগরের কাছে ভিসটুল নদীর তীরে ছোট বন্দর শহর। বাবা ছিলেন একজন সাধারণ ব্যবসায়ী। কোপারনিকাসের পারিবারিক নাম ছিল নিকলাস কোপার্নিক। কোপার্নিক শব্দের অর্থ বিনয়ী।

শুধু নামে নয় আচার ব্যবহারে স্বভাবেও কোপার্নিকাস ছিলেন যথার্থই বিনয়ী। ছেলেবেলা থেকেই কোপার্নিকাসের আকাশ গ্রহ নক্ষত্র চন্দ্র সূর্য তারা সম্বন্ধে ছিল গভীর কৌতূহল। এই সব বিষয়ে বাবা-মাকে নানা প্রশ্ন করতেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তরই জানা ছিল না ব্যবসাদার বাবার।

কোপার্নিকাসের কাকা ছিলেন ধর্মযাজক পন্ডিত মানুষ। ভাইপোর জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ দেখে একটি বই পাঠিয়ে দিলেন। এই বইটি ছেলেবেলায় কোপারনিকাসের সব সময়ের সঙ্গী ছিল। শুধু অ্যারিস্টরকাস নয়, পরবর্তী যুগে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চম চার্লসের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ওরসিমি অ্যারিস্টটলের অভিমতের বিরুদ্ধে গতিশীল পৃথিবীর ধারণার কথা বলেন।

কুপার নিকলাস নামে এক পন্ডিত বলেন, গ্রহ নক্ষত্রের মতো পৃথিবীও আবর্তিত হচ্ছে। লিওনার্দ দ্য ভেঞ্জিও বিশ্বাস করতেন পৃথিবী স্থির নয়, গতিশীল। তিনি বললেন, শুধুমাত্র বিশ্বাস নয়, পরীক্ষার দ্বারাই একমাত্র প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া যায়। তাছাড়া কোপার্নিকাসের শিক্ষক ডোমেনিকোও অ্যারিস্টটলের মতে বিশ্বাস করতেন না।

এই পরস্পর বিরোধী অভিমতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোপার্নিকাসের মনে হল প্রকৃত সত্যকে উদঘাটন করতেই হবে। যে বিষয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান কেমন করে তা ছাত্রদের পড়াচ্ছেন এমন সময় একটি ছাত্র তাকে প্রশ্ন করল, আপনি যা বলছেন তা কি বিশ্বাস করেন?

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন কোপার্নিকাস। মানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিলেন। ফিরে এলেন কাকা লুকাসের কাছে ফ্রাউয়েনবার্গে। এখানে তিনি গ্রাম্য যাজকের কাজ নিলেন। এই সময় থেকে শুরু হলো তার জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার পালা। কার অভিমত সঠিক টলেমি না পিথাগোরাস?

ফ্রাউয়েনবার্গ ছিল একটি পাহাড়ি গ্রাম। অল্পদিনের মধ্যেই সেখানকার মানুষদের সাথে একাত্ম হয়ে গেলেন কোপার্নিকাস। তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে পড়তেন। গির্জার কাজের চেয়ে মানুষের সেবাযর কাজেই তার ছিল বেশি আনন্দ। অসুস্থ মানুষেরা তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসত।

অল্পদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোপার্নিকাস ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। নানা বিষয় ছিল তার সহজ দক্ষতা। গ্রামের মানুষদের জল আনবার জন্য দীর্ঘ দুই মাইল দূরে নদীতে যেতে হত। তিনি পাহাড়ের মাথায় বাঁধ বেঁধে দিয়ে গ্রামে জল নিয়ে এলেন।

গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন জ্ঞান ও দয়ার প্রতীক। শুধুমাত্র চিকিৎসা আর সমাজসেবা নয়, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্বন্ধেও তার ছিল সুগভীর জ্ঞান। তিনি নানা ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিতেন। অর্থনীতির উপর তিনি একটি বই লিখেছিলেন।

এই বইতে সে যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নানান ভুল ত্রুটির উল্লেখ করেছিলেন। তার বহু অভিমত সরকার গ্রহণ করে। তিনি দেখিয়েছিলেন একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকরা বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা তৈরি করে। তিনি বললেন এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়।

এক অঞ্চলের মুদ্রা অন্য অঞ্চলের মানুষ গ্রহণ করতে চায় না। তাছাড়া বিদেশি বণিকদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করবার সময় নানান অসুবিধা দেখা দেয়। লাভের আশায় শাসকেরা ইচ্ছামত মুদ্রার মান কমায় বা বাড়ায়। কোপার্নিকাস সারাদেশে একই ধরনের মুদ্রা চালু করবার কথা বললেন।

তাছাড়া মুদ্রার মান কমানোর বিপক্ষেও তিনি অভিমত প্রকাশ করতেন। কোপারনিকাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো আধুনিক ক্যালেন্ডার এর প্রবর্তন করা। ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পর থেকে তাতে বিশেষ কোনো সংশোধনের কাজে হাত দিলেন এবং সঠিকভাবে দিন মাস বছরের হিসাব নির্ণয় করলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম বছরের সঠিক কাল পরিমাণ আবিষ্কার করেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *