জীবনী: উইলিয়াম হার্ভে

উইলিয়াম হার্ভে

শরীরে রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে । পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ছিল মানুষের। সেই ভুল ধারণা নিয়েই এতকাল মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক উইলিয়াম হার্ভে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ১৬২৮ সালে একটি বাহাত্তর পৃষ্ঠার বই বার করেন। এই ছোট বইটার মধ্যে তিনি তুলে ধরেছেন শরীরের জটিল সমস্যাগুলো। ১৫৭৮ সালে ১লা এপ্রিল ফোকস্টোনে উইলিয়াম হার্ভের জন্ম হয়।

তার পিতা ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। উইলিয়াম প্রথমে কিংস স্কুলে ও পরে ক্যামব্রিজে পড়াশুনা করেন। ১৫৯৭ সালে তিনি পাদুয়ায় পড়তে আসেন। এই পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্যাব্রিমিয়াসের কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করেন। যা পরবর্তীকালে তার আবিষ্কারে সাহায্য করে।

বিজ্ঞানী ফ্যাব্রিমিয়াসই বলেন যে মানুষের শরীরে শিরার মধ্যে ভালভ বা কপাটক আছে। এই ভালভ বা কপাটকের কি কাজ তিনি বুঝতে পারেননি। তাই রক্ত সঞ্চালনের ব্যাখ্যা অসমাপ্তই রয়ে গেল। হার্ভে তা পরীক্ষার দ্বারা দেখালেন যে এই ভালভ বা কপাটকই হৃৎপিণ্ডে অন্য যে কোন দিক থেকে রক্তের প্রবাহকে বাধা দেয়।

তিনি রক্তের সঞ্চালনের গুরুত্ব বিষয়ে আবিষ্কার করলেন। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রি নিয়ে তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। ১৬০৯ সালে তিনি বার্থোলোমিউ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি রোগীদের পরীক্ষা করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন ও এই সিদ্ধান্তে এলেন যে মানুষের শরীরের রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে এতদিন যা ধারণা ছিল তা সবাই ভুল।

তবে পুরনো তথ্যের ভুলটা কোথায় সেটা জানার জন্যে তিনি বছরের পর বছর যা পেয়েছেন তাকেই কাটাকুটি করে দেখেছেন। সব জন্তু জানোয়ার, পাখি, ব্যাঙ, সাপ ইঁদুর সবই তিনি কাটাকুটি করেছেন ও তার সাথে পরীক্ষাও করেছেন। মানুষের শরীরে যে হৃদপিণ্ড আছে তাতে চারটে প্রকোষ্ঠ।

ডানদিকে ও বামদিকে আছে হৃৎকোষ বা অলিন্দ। তাছাড়া ডানদিকে ও বামদিকে রয়েছে হৃদপিন্ডের রন্ধ্র। সোজাসুজি হৃদপিণ্ডকে ভাগ করে রয়েছে সেপটাস বা পর্দা। আগে রক্ত সঞ্চালনের সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের যে ভুল ধারণা ছিল তা হচ্ছে যকৃৎ থেকে রক্ত তৈরি হয় এবং রক্ত দুই ধরনের।

প্রথম রকমের রক্ত হলো হৃদপিন্ডের দক্ষিণ নিলয় থেকে রক্ত উৎপত্তি হয়ে শিরার মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়। আরেক প্রকার বাম নিলয় থেকে উৎপত্তি হয়ে ধমনীর মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়। পরে বিজ্ঞানী মাইকেল সের্ভেটাস ফুসফুসীয় সংবহনের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

তার এই ব্যাখ্যা ধর্মবিরুদ্ধ বলে তাকে পুড়িয়ে মারা হয় ও তার লেখা বইটিকে নষ্ট করে ফেলে। এখন তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শোণিত সংবহন পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু চারশ বছর আগে এটা খুবই কঠিন কাজ ছিল। তখন তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল না।



ফ্যাব্রিসিয়াসের কাছ থেকে হার্ভে জেনেছিলেন শিরার কপাটক আছে। এই কপাটকের মানেই হলো রক্ত একমাত্র শিরার ভেতর দিয়ে একদিকে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু কোন দিকে রক্ত প্রবাহিত হয় সে কথা তিনি বলতে পারেন নি। হার্ভে দেখলেন এই রক্ত প্রবাহ হয় হৃদপিন্ডের দিকে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে রক্ত কোথা থেকে আসছে? পাকস্থলী বা যকৃত থেকে রক্ত আসছে এই আগে ধারণা ছিল, কিন্তু উইলিয়াম হার্ভে তা পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন যে রক্ত মোটেই দুই রকমের নয়। একই রকমের রক্ত শিরা ও ধমনীতে প্রবাহিত হয়।

রক্ত শুধু হৃদপিন্ডের মধ্যেই নয় শরীরের সব জায়গায় এবং সবসময় একই দিকে প্রবাহিত হয়। হৃদপিণ্ড থেকে যে রক্ত পাম্পের মত প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে, বৃত্তাকারে তা শরীরে প্রবাহিত হয় এবং আবার তার সূত্রে ফিরে আসে। শোণিত সংবহন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু হওয়া।

হৃদপিণ্ড এ কাজ করে রক্তবাহী নালীর সাহায্যে। উইলিয়াম হার্ভে তার আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করতে চাননি। ১৬১৫ সালে বই প্রকাশের বার বছর আগে রয়্যাল কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তার আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করেন। তখন কেউই পাত্তা দেয়নি।

১৬২৮ সালে তার গবেষণা প্রায় বন্ধ হওয়ার পর চিকিৎসা মহলে বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেই সময় তার গবেষণা প্রায় বন্ধ হবার মুখে। হার্ভের বিরোধীরা অনেক পরীক্ষা করেও হার্ভের আবিষ্কারকে নিয়ে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারল না। তারা দেখলেন হার্ভের কথাই ঠিক ও অভ্রন্ত।

তার আবিষ্কারে ডাক্তারদের চিকিৎসসাও ভালো হতে থাকে। এতে ডাক্তারদের প্র্যাকটিস বেড়ে গেল। যার ফলে হার্ভের খ্যাতি ও যশ বেড়ে গেল। তিনি প্রথম চার্লসের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। প্রথম চার্লস হার্ভের আবিষ্কারে খুব খুশি হন। তিনি তাকে গবেষণার জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলেন।

হার্ভে রাজাকে তার বই উৎসর্গ করলেন, এই বলে যে শরীরের কাছের হৃদপিন্ডের যে স্থান, রাজত্বের কাছেও রাজার সেই স্থান। তিনি খুব রাজার ভক্ত ছিলেন। এরপর লাগল গৃহযুদ্ধ। রাজার সাথে হার্ভে ত্যাগ করলেন লন্ডন। প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যেও তিনি গবেষণা করে যান।

তিনি রাজার সঙ্গে অক্সফোর্ড সফরে যান। রাজপরিবারের প্রতি তার সমর্থন ছিল বলে তার বার্থোলোমিউ হাসপাতালের চাকরিটাও চলে যায়। অক্সফোর্ড ছেড়ে তিনি চলে আসেন লন্ডনে। তিনি খুব ভুগছিলেন গেঁটেবাতের যন্ত্রণায়। তখন তার বয়স ছিল আটষট্টি।

১৮৮৩ সালে কলেজের ফেলোরা হার্ভের যাবতীয় স্মৃতি সরিয়ে সংরক্ষণ করেন হেম্পস্টেড গির্জার মার্বেল পাথরে তৈরি হার্ভে স্মৃতিকক্ষে। উইলিয়াম হার্ভের আবিষ্কার চিকিৎসা জগতে এক অমর কীর্তি। ১৬৫৭ সালে তার মৃত্যু হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এক ভাইপোকে দিতে না দিতেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *