জীবনী: ক্যারোলাস লিনিয়াস সুইডেনের প্রকৃতি বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াসই সর্বপ্রথম প্রাণী জগতের বিজ্ঞানভিত্তিক ও সুসমন্বিত শ্রেণীবিন্যাস করেন। শ্রেণীবিন্যাস করতে গিয়ে তিনি প্রাণিজগতকে তিনটি দলে ভাগ করেন। যেমন–
১. Primates বা প্রথম
২. Secundat বা দ্বিতীয়
৩. Tertiates বা তৃতীয়।
প্রথম দলে তিনি বাঁদর, বনমানুষ ও মানুষকে স্থান দেন এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ীকে স্থান দেন দ্বিতীয় দলে।
অবশিষ্ট সকল প্রাণীকে তিনি তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত করেন। তৃতীয় দলে আছে আবার পাঁচটি শ্রেণি। এগুলো হলো–
১. ভারমিস–কীটপতঙ্গ ছাড়া সকল অমেরুদন্ডী প্রাণী।
২. ইনসেকটা–সমস্ত রকম কীটপতঙ্গ।
৩. পিসেস–সমস্ত রকম মাছ।
৪. অ্যাম্ফিবিয়া–সমস্ত রকম উভচর প্রাণী।
৫. অ্যাভিস–সমস্ত পাখি।
পরবর্তীকালে প্রাণী জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞানবিকাশের সাথে সাথে এই বিন্যাস করণ আরো উন্নত ও সুবিন্যস্ত হয়েছে। এর প্রচুর সংশোধন হয়েছে। তবে সব কিছুর মূলে ছিল লিনিয়াসের তত্ত্ব। তার গবেষণার উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়েছে পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা।
শুধু প্রাণী জগতের শ্রেণীবিন্যাস করণ নয় তিনি প্রাণীর প্রজাতির নামকরণেরও একটি বিজ্ঞানসম্মত কাঠামো তৈরি করেন। লিনিয়াস ১৭৫৩ সালে সর্বপ্রথম দুটি অংশে এক-একটি প্রজাতির নামকরণ করার প্রথা প্রচলন করেন। এই প্রথা অনুসারে প্রত্যেক প্রাণীর নামে দুটো অংশ থাকে। এর প্রথম অংশটি ‘গণনাম’।
এবং দ্বিতীয় অংশ প্রজাতির নাম। একটি গণের সভ্য সকল প্রজাতির গণনাম একই হবে, শুধু তাদের প্রজাতির নাম ভিন্ন হবে। যেমন গৃহপালিত কুকুরের নাম Canis Familiarts এবং একই গণভুক্ত শিয়ালের নাম Canis Aureus আবার একই গণভুক্ত নেকড়ে বাঘের নাম Canis Lupus।
এ ধরনের নামকরণকে দ্বি-নামী নামকরণ বা দ্বি-পদ নামকরণ বলে। এ ধরনের নামকরণ পদ্ধতিতে অপর একটি করণীয় হল-গণ ও প্রজাতি নামের পর ঐ প্রজাতির বিবরণদাতা এবং প্রথম নামকরণের নাম উল্লেখ করতে হবে। যেমন মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হল Homo Sapiens এবং এই নামের প্রথম প্রবর্তক হলেন বিজ্ঞানী লিনিয়াস।
তাই সঠিকভাবে মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম লিখতে গেলে লিখতে হবে Homo Sapiens Linnaeus। বিজ্ঞানী লিনিয়াসের জন্ম হয়েছিল ১৭০৭ সালের ২৩ই মে সুইডেনের সাউথ রেশাল্ট নামক স্থানে। এখানে তার বাবা ছিলেন স্থানীয় একটি গির্জার যাজক। একবারে বাল্যকাল থেকেই উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল লিনিয়াসের।
রবীন্দ্রনাথের গল্পের বলাই চরিত্রের মতোই সারাদিন তিনি পড়ে থাকতেন গাছপালা আর ফুল ফল নিয়ে। কোন গাছ কেমন করে জন্মায়, কোন ফুল কেমন করে ফোটে এসব লক্ষ্য করে করেই তার দিন কাটত। তাই তার যখন সাত আট বছর বয়স তখনি তাকে সবাই ঠাট্টা করে বলত ক্ষুদে উদ্ভিদবিজ্ঞানী।
তিনি প্রথমে স্থানীয় লান্ড নামক স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে স্থানীয় অপসালা কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যখন আপসালা কলেজে পড়াশোনা করতেন, তখন সেখানে ওলোফ সেলসিয়াস নামে জনৈক বিখ্যাত বিজ্ঞান উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।
অধ্যাপক সেলসিয়াসের সংস্পর্শে এসেই লিনিয়াস আরো বেশি করে উদ্ভিদ-বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মূলত পরবর্তীকালে লেনিয়াস যে, জগদ্বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী হয়েছিলেন তার মূল অনুপ্রেরণাদাতাই ছিলেন অধ্যাপক সেলসিয়াস।
পড়াশোনা শেষ করে তিনি আপসালা কলেজেই ১৭৩০ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রভাষক নিয়োজিত হন। দুবছর তিনি এই কলেজে ছিলেন। পরে বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন আপসালা সাইন্সে একাডেমিতে। বিজ্ঞান একাডেমিতে যোগদানের পর তার গবেষণার সুযোগ এসে যায়। তিনি ভ্রমণ করেন বিভিন্ন দেশ।
পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীর সংস্পর্শেও আসার সুযোগ হয়। এই সময় তিনি তার গবেষণার ফসল নিয়ে ১৭৩৭ সালে প্রকাশ করেন তার থিসিস গ্রন্থ–ফ্লোরা ল্যাপোনিকা। পরে বইটি ১৮১১ সালে স্যার জে. ই. স্মিথ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই বইটি প্রকাশের পরই তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি বিজ্ঞানী হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করেন।
- আরো পড়ুন: জীবনী: উইলিয়াম হার্ভে
- আরো পড়ুন: আইফেল টাওয়ারের রহস্যময় ইতিহাস
- আরো পড়ুন: আলহামদুলিল্লাহ কখন ও কেন বলবেন?
আবশ্য ১৭৩৫ সালেও ‘সিস্টেমা নেচারাল’ নামে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশিত হয়েছিল। এর দু’বছর পর ১৭৩৭ সালে বের হয় ‘জেনেরা প্ল্যান্টারাম’ গ্রন্থ। তার সিস্টেমা গ্রন্থটি দশম তম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৭৫৮ সালে। এই সংস্করণে পূর্বে জ্ঞাত সকল প্রাণীর নামের তালিকা সন্নিবেশিত করা হয়।
আধুনিক নামকরণ ও নাম ঐ পুস্তকের প্রকাশকাল থেকে ধরা হয়। এর আগে প্রকাশিত সকল নাম অগ্রাহ্য হয়। তাই লিয়াসের এই সিস্টেমা নেচারেল গ্রন্থটিই জীববিজ্ঞানের গবেষণার মূল ভিত্তি। লিয়াসের সিস্টেমা গ্রন্থটি নিয়ে আরো মজার কথা আছে তিনি বইটির পান্ডুলিপি তৈরি করে নিয়ে যান বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানীর জ্যান ফ্রেডরিক গ্রোনোভিটিয়াস এর কাছে।
উদ্দেশ্য ছিল তার তথ্যগুলো সম্পর্কে মতামত নেয়া এবং প্রয়োজনে সংশোধন করা। কিন্তু গ্রোনোভিটিয়াস তার পান্ডুলিপি পড়ে এতই মুগ্ধ হয়ে যান যে, তিনি নিজেই পয়সা খরচ করে এটি পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। লিনিয়াস তার সিস্টেমা বইটি রচনা করেছিলেন ফুল ও ফলের গাছসমূহের শ্রেণীবিন্যাসের উপর।
১৭৩৬ সালে তিনি ইংল্যান্ডে সফর করেন এবং লন্ডনে এসে বিখ্যাত বোটানিস্ট এবং চিকিৎসক স্যার হ্যান্স স্লোয়ানের সাথে পরিচিত হন। এখানে এসে তার আরেকজন বোটানিস্টের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বোটানির অধ্যাপক জোহান জ্যাকব ডিলেনিয়াস।
পরে তিনি আবার সুইডেনে ফিরে আসেন এবং ১৭৩৮ সালে স্টকহোমে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন এবং এখানেই চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এখানে তিনি সারা মোরায়েয়া নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেন। সারাও ছিলেন জনৈক চিকিৎসকের কন্যা। বিয়ের দুই বছর পর তিনি আপসালা কলেজের মেডিসিনের চেয়ারম্যান হন।
এক বছর পরে তিনি এই কলেজেরই বোটানির চেয়ারম্যান হন। তার আরো কৃতিত্ব আছে। তিনি প্রাণী এবং উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এটাই তার বড় পরিচয়। কিন্তু তিনি এছাড়াও আরো একটি বড় কাজ করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে প্রাপ্ত সমস্ত খনিজ সম্পদের একটি সুন্দর শ্রেণীবিন্যাস করেছেন।
এ ছাড়া তিনি রোগ ব্যাধিরও একটি শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এটাও ছিল তার আরেক কৃতিত্ব। শেষ জীবনে তিনি আবার শিক্ষকতা এবং গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। এরপর তার যেসব গবেষণাধর্মী গ্রন্থসমূহ প্রকাশিত হয় সেগুলো হল ‘ফ্লোরা সুইসিকা’ ‘ফ্যনা সুইসিকা’।
ফ্যনা হল তার সুইডেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ফল। এর আছে দুটি খন্ড। ১৭৪৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভাস্টগোটা রেসা’ ১৮৪৮ সালের বের হয় ‘হোরটাস আফসালিয়েনসিস’। ১৭৫১ সালে বের হয় ‘স্কানস্কা রেসা’ এবং ফিলোসোফিয়া বোটানিকা।
১৭৫৩ সালে বের হয় ‘স্পেসিস প্ল্যান্টারাম’ এই গ্রন্থেই প্রাণী ও উদ্ভিদের সকল প্রজাতির নাম সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ১৭৫৫ সালে তিনি স্পেনের রাজার কাছ থেকে স্পেনে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আমন্ত্রণ পান। তাকে মোটা অংকের সম্মানী ভাতা দানেরও ঘোষনা দেওয়া হয়।
কিন্তু তিনি স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে রাজি হননি। ১৭৭৪ সালে তিনি একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং দিনে দিনে তার শরীর ভেঙ্গে পড়তে থাকে। শরীর ক্রমে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত তিনি বিছানায় পড়ে যান। এই বিছানায় থেকেই তিনি ১৮৭৮ সালের ১০ই জানুয়ারি পরলোক গমন করেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লিনিয়াসের নাম চিরদিন লেখা থাকবে। কারণ লিনিয়াস আজ আর একটি নাম নয় একটি গবেষণার প্রতীক।
- আরো পড়ুন: অনলাইনে বই পড়ার ৫ টি অ্যাপস
- আরো পড়ুন: পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যেসব কারণে
- আরো পড়ুন: শিশুর মুখের র্যাশ দূর করার উপায়
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।
বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।