জীবনী: হারবার্ট স্পেনসার

হারবার্ট স্পেনসার

দার্শনিক হারবার্ট স্পেনসার ছিলেন বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের সমসাময়িক লোক। ডারউইন যেমন জীবের বিবর্তনের উপর সূত্র দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন তেমনি স্পেনসারও জীবের বিবর্তনের উপর গবেষণা করেছিলেন। স্পেনসারের মতে পৃথিবীতে মানবজাতির আবির্ভাব কোন আকস্মিক ঘটনা নয়।

এটা বাস্তব এবং অবশ্যম্ভাবী ঘটনার পরিণতি মাত্র। তিনি বলেছেন, জীবনের যে শুরু তা ক্ষুদ্র এবং অপ্রধান কোন বস্তু থেকে শুরু। সে ক্ষুদ্র এবং অপ্রধান জৈবিক বস্তুর বিবর্তন ঘটতে ঘটতেই তার রূপান্তর হয়েছে, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে ঘটেছে মানবজাতির আবির্ভাব।

তিনি তার প্রাকৃতিক দর্শন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জীববিজ্ঞান, সামাজিক রহস্য, নৃতত্ব, দর্শন সকল কিছুকে সমন্বয় করে দাঁড় করিয়েছেন তার মূল সূত্র। ডারউইন তার সূত্র দাঁড় করিয়েছিলেন বিজ্ঞানের ভিত্তির উপর, কিন্তু স্পেনসারের সূত্র ছিল বিজ্ঞান ও সামাজিক পরিবেশের সমন্বয়ে গঠিত।

একজন খাঁটি বিজ্ঞানের সাথে একজন দার্শনিকের এখানেই মৌলিক পার্থক্য। হারবার্ট স্পনসারের জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের ডারবিতে ১৮২০ সালের ২৭ এপ্রিল। পিতা উইলিয়াম জর্জ স্পনসার ছিলেন একজন স্কুল মাস্টার। তার পিতা মাতা দুজনেই ছিলেন খুব ধর্মভীরু। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি ছিল তাদের গভীর শ্রদ্ধা।

ডারবি শহরেই শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। পরে তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর পড়াশোনা করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে আসার পর তিনি কিছু দিন শিক্ষাকতাও করেছিলেন। তারপর চাকরি নিয়েছিলেন রেলওয়েতে। তিনি রেলওয়েতে ১৮৩৭ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের পদে চাকরি করেন।

রেলওয়ের চাকরি ছাড়ার পর থেকেই শুরু হয় তার লেখালেখি। তিনি ১৮৪৩ সালে পুস্তিকাকার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘দি প্রপার স্ফেয়ার অব গভর্নমেন্ট’। এই প্রবন্ধেই তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকটি দেশের সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল প্রাকৃতিক অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া।

পরে এই লেখালেখির সূত্র ধরেই তিনি সাংবাদিকতার সাথেও জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রথম দিকে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তার লেখা ‘দি জিয়োইস্ট’ প্রবন্ধটি ছিল উল্লেখযোগ্য। সম্মোহন বিদ্যা ও মস্তিষ্কতত্ত্ব নিয়ে লেখা প্রবন্ধটিও প্রকাশিত হয় দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায়।

এরপর ‘দি পাইলট’ নামে আরো একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও প্রকাশিত হয় এই পত্রিকায়। ফলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে তার জানাশোনা হয়ে যায় এবং তিনি এই পত্রিকায় সাবএডিটরের পদে চাকরিও নিয়ে নেন।
১৮৫১ সালে তিনি সোসিয়াল স্ট্যাটিক্স নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। এটি ছিল সমাজ বিজ্ঞানের উপর লেখা।

এর আগেই ১৮৫০ সালে তার সাথে পরিচয় ঘটে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ম্যারিআন ইভানস-এর সাথে – যার সাহিত্যিক ছদ্মনাম হল জর্জ ইলিয়ট। ম্যারির সাথে দর্শন নিয়ে প্রায় তার দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হত। দুজনকে প্রায়ই একত্রে দেখাও যেত। তাই অনেকে মনে করেছিলেন হয়তো তারা শীঘ্রই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছেন। কিন্তু তা হয়নি।

পরবর্তী সময়ে স্পনসারের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় তিনি ম্যারিকে প্রেমিক গ্রুপে দেখতেন না। ম্যারি ছিলেন তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। ওর সাথে কোন বিষয় নিয়ে আলাপ করলেই অনেক জটিল বিষয় তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। ম্যারি ছিলেন শুধু তার মেয়ে বন্ধু প্রেমিকা নন।

স্পনসারের কয়েকজন ছেলে বন্ধুও ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন জি. এইচ. লেওয়েস, থমাস হেনরি হাক্সলি এবং জন স্টুয়ার্ট মিল। ১৮৫৩ সাল ছিল স্পনসারের জন্য সৌভাগ্যের বছর। নিঃসন্তান মামার এক বিশাল সম্পত্তি তিনি পেয়ে যান। মামা উইল করে তার যাবতীয় সম্পত্তি স্পনসারকে দান করে যান।



এবার তার অর্থের অভাব ঘুচে গেল। তিনি ছেড়ে দিলেন পত্রিকার চাকরি। শুরু করলেন এক মনে দর্শন নিয়ে গবেষণা এবং গ্রন্থ রচনা। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হলো তার ‘দি প্রিন্সিপলস অব সাইকোলজি’ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয় ‘দি সিন্থেটিক ফিলোসফি’ গ্রন্থটি।

অবশ্য এই বইটিতে ইতিপূর্বে ‘দি প্রিন্সিপাল অব সাইকোলজি’ গ্রন্থটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও এ তে অন্তর্ভুক্ত করা হয় জীববিদ্যা, সমাজবিদ্যা এবং নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত অনেক প্রবন্ধ। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয় ‘দি ফার্স্ট প্রিন্সিপালস’ এবং ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় এই সিরিজের সর্বশেষ গ্রন্থ ‘দি প্রিন্সিপ্যালস অব সোসিয়োলজি’।

এই ‘দি প্রিন্সিপালস অব সোসিয়োলজির’ পটভূমি ব্যাখ্যা করার জন্য স্পেনসার ১৮৭৩ সাল থেকে শুরু করেন আরেকটি সিরিজ গ্রন্থ, যার নাম ছিল ‘ডেসস্ক্রিপটিভ সোসিয়োলজি’। এই বইটিতে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সভ্য ও আদিসমাজের সামাজিক কাঠামো ও জীবন-যাত্রার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন।

কিন্তু তিনি সমাজতত্ত্বের যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন তা তৎকালীন পাঠক সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। গ্রন্থটি বিতর্কের সৃষ্টি করে। পাঠকগণ তার সূত্রকে সহজভাবে গ্রহণ না করলেও তার এক অনুরাগী বন্ধু ছিলেন বিয়াত্রিস পটার। এই মহিলা ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন বোদ্ধা পাটিকা এবং তার উপদেষ্টাও।

তিনি সবসময় স্পেনসারকে উৎসাহ দিতেন, মনোযোগ দিয়ে তার লেখা পড়তেন। যখন স্পেনসার একবার অসুখে পরেছিলেন তখনও এই বিয়াত্রিসই তার সেবাযত্ন করেছেন। শেষ জীবনে যখন স্পেনসার অসুস্থ অবস্থায়ও তার আত্মজীবনী মাই অ্যাপ্রেনটিসশিপ রচনা করেছিলেন তখনো বিয়াত্রিস তার পাশে ছিলেন এবং লেখার ব্যাপারে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।

হারবার্ট স্পেনসারের মৃত্যু হয় ১৯০৩ সালের ৮ ডিসেম্বর। চিরকুমার স্পেনসার মৃত্যুর আগে তার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য একটি ট্রাস্টিবোর্ড গঠন করে যান এবং একটি উইল করে যান। এই উইলের একটি প্রধান শর্ত ছিল, তার সিরিজ গ্রন্থ ডেস্ক্রিপটিভ সোসিয়োলজির প্রকাশনার ব্যাপারে।

তিনি বইটির পান্ডুলিপি সমাপ্ত করে গেলেও এর সবগুলো খন্ড প্রকাশ করার সময় পাননি। তাই তিনি উইলে এই বলে শর্ত দিয়ে যান যে, তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির আয় থেকে যেন এই সিরিজ গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়।
ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন বিয়াত্রিস। বিয়াত্রিস তার বন্ধুর শেষ অনুরোধ পালন করেছিলেন।

বইটি ছিল ১৯টি খন্ড। সবগুলো খন্ড প্রকাশ করতে সময় নিয়েছিল ১৮৭৩ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত। স্পনসারের মৃত্যুরও ৩০ বছর পরে এ প্রকাশনা শেষ হয়। হারবার্ট স্পেনসার ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগে চিন্তাবিদদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত ও তিনি তার মতামত প্রকাশ করতে অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে এবং সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে দাঁড় করাতেন তার মতামত।

তিনি সামাজিক প্রতিটি রহস্যকে যুক্তি ও তর্কের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তার সকল চিন্তা চেতনা একটি সূত্রে গাথা এবং সেগুলো সুশৃংখলভাবে সাজানো। তিনি এলোমেলো কিছু ভাবেন না, বলেনও না। তার মতে বিজ্ঞান এবং দর্শন পরস্পরের সহযোগী।

একটির সহায়তা ব্যতীত অন্যটির সফলতা লাভ হয় না। তিনি বলতেন, দর্শনের জন্ম হয় সমাজবিজ্ঞানের নানারকম মৌলিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে। সমাজের প্রতি প্রাণী তাদের সকলের সংবদ্ধ জীবন যাপন প্রণালী এই নিয়েই তো জৈবিক বিবর্তন ধারার ইতিহাসের জন্ম হয়।

এই চিন্তার ধারাবাহিক চেতনা বা উপলব্ধি হল দর্শন আর তার সাফল্য আসে বিজ্ঞানের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। তিনি ১৮৫২ সালে লিখিত ‘দি ডেভেলপমেন্ট হাইপথেসিস’ প্রবন্ধে বলেছেন, বিশ্বের কোনো একটি জাতের প্রাণীও আবির্ভাব আকস্মিকভাবে হয়নি। প্রতিটি জীবের আবির্ভাবের মূলেই আছে তার কারণ এবং একটি নীতিমালা।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *