জীবনী: হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা

হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা

জীবনী: হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা ঊনিশ শতকে ভারতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, শিল্পকলা এবং রাজনীতিতে এসেছিল এক নবজাগরণ। পরাধীন ও মৃতপ্রায় জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে এই সময় থেকে শুরু হয়েছিল প্রানের জোয়ার।

ঊনিশ শতকের এই নবজাগরণের উত্তরসূরী হয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে বোম্বাই শহরের এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উত্তরকালের বিশ্বখ্যাত পরমানুবিজ্ঞানী এবং ভারতের পারমাণবিক গবেষণার অগ্রদূত হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। ভাবার জন্ম হয়েছিল ১৯০৯ সালে ৩০ শে অক্টোবর তারিখে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভাবার জন্ম মুহূর্তটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভির্টি’ আবিষ্কারের ফলে বিশ্বজগত সম্পর্কে পুরনো ধ্যান ধারণা বদলে যেতে শুরু করেছিল। সৃষ্টি হচ্ছিল নতুন প্রজন্মের নতুন চিন্তাচেতনার।

ভাবারা ছিলেন পুরুষানুক্রমে শিক্ষিত এবং বৃত্তশালী। বাবা ছিলেন অভিজ্ঞ আইন ব্যবসায়ী এবং টাটা কোম্পানির প্রধান আইন উপদেষ্টা। এ ছাড়া টাটা পরিবারের সাথে ভাবা পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধনও ছিল। হোমির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন মহিশূরে পিতামহের নিকটে থেকেই শিক্ষা জীবনের হাতে খড়ি হয়।

হোমি বাল্যকাল থেকে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাই তার অভিভাবকগণ কিছুদিন যেতে না যেতে বুঝতে পারলেন এই ছেলে একদিন বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। বাল্যকালেই তার মধ্যে কতগুলো অসাধারণ গুন দেখা গিয়েছিল। যেমন ছোটবেলা থেকে তার ঘুম খুব কম ছিল। এই নিয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করে কোন রোগের সন্ধান পেলেন না।

বললেন, ওর দেহে কোন রোগ নেই, তবে ওর মস্তিষ্ক প্রায় সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকে এবং ভেতরে অনবরত চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হয়। আর তারই ফলে ঘুম কম হয়। তবে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এটা কোন রোগ নয়। হোমি শৈশবে চমৎকার ছবি আঁকতে পারতেন।

তার এই ছবি আঁকা তাকে কেউ শেখাননি, তার মস্তিষ্ক এত সৃজনশীল ছিল যে, কোন কিছু শিক্ষা না করেও তা তিনি করতে পারতেন। মহিশূরে হাতে ঘড়ি হওয়ার পর বোম্বাই শহরে এনে আবার তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় একটি মিশনারি হাই স্কুলে।

এখানে দু’বছর পড়ার পরে তাকে কলোন নামে আরেকটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা পাস করেন প্রথম স্থান অধিকার করে। পরে বোম্বাই শহরে সেরা কলেজ এলফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন।

এখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি বোম্বাইয়ের রয়েল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স কলেজে ভর্তি হন। এই ইনস্টিটিউটে দুবছর পড়ার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাকে পাঠানো হয় বিলেতে। সেখানে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। ক্যামব্রিজে ভর্তি হয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য।

১৯৩০ সালে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এ টাইপস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২১ বছর। ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাস করলেও ভাবার মত প্রতিভাবান ছেলেরা শুধুমাত্র একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য জন্মাননি। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ছেড়ে দিল না।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আরও উঁচুদরের একটি বৃত্তি প্রদান করে যার নাম নিউটন স্কলারশিপ। এই বৃত্তি পাওয়ার পর তিনি একটি থিসিস সাবমিট করেন এবং এই গবেষণার ফলেই তাকে কেমব্রিজ থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী প্রদান করা হয়। তারপরও শেষ নয়। তাকে ১৮৫১ এক্সিবিশন স্টুডেন্টশিপ দেওয়া হয়।

হোমি বিলেতে এসেছিলেন মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। কিন্তু তাকে এগুতে হল আরো অনেক দূর। এখানে নতুন কোয়ান্টাম থিওরিতে গবেষণারত পদার্থবিদদের সংস্পর্শে এসে হোমির মনে প্রকৃতির পদার্থগত সমস্যাসমূহের গভীরে প্রবেশ করার আগ্রহ জেগে ওঠে।



তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৬ সালে এক্সিবিশন বৃত্তি লাভ করে ভাবা কোপেনহেগেনে বোর ইনস্টিটিউটে কিছুদিন কাটান এবং ডব্লিউ নাইট রোবরের সহযোগিতায় আবিষ্কার করেন নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যার নাম হলো ক্যাসকেড থিওরি অব কসমিক রে শাওয়ার।

এই তত্ত্ব আবিষ্কারই সারা ইউরোপে এই তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানীকে পরিচিত করে তোলে। এই মৌলিক গবেষণার জন্যই তিনি ১৯৩৭ সালে অ্যাডমস পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষাশেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ১৯৪০ সালে ভারতের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী সি. ভি. রমনের অধীনে ব্যাঙ্গালোরে সাইন্স ইন্সটিটিউটে কাজে যোগদান করেন।

১৯৪১ সালে তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। এটি ছিল তার জীবনের এক গৌরবময় ঘটনা। রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপথ পাওয়া খুবই গৌরবের কথা। ১৯৪৫ সালে হোমি ভাবার চেষ্টাতেই এবং টাটা কোম্পানির অর্থানুকূল্যে বোম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত হয় পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ।

তিনিই হলেন এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ভাবা যখন টাটা ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর তখন একদিন তিনি একটি চিঠি পেলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহারুর কাছ থেকে। নেহেরু তার সরকারি বাসভবনে ভাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন যে, ভারত সরকার পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন সংক্রান্ত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চান এবং এই কাজে তাকে দায়িত্ব নিতে হবে।

ভাবার জন্য এটি ছিল অত্যন্ত সম্মানের পদ ও দায়িত্ব। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। ভাবা যথাশীঘ্র সম্ভব প্রকল্প তৈরি করে দিলেন নেহেরুর হাতে। এই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৮ সালের লোকসভায় নতুন আইনগৃত হলো অ্যাটোমিক এনার্জি অ্যাক্ট অব ১৯৪৮। এই আইনের ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে ভারতে গঠিত হয় পারমাণবিক শক্তি কমিশন।

ভাবা হলেন এই কমিশনের চেয়ারম্যান। ভাবা ভারতের পারমানিক শক্তি কমিশনের কার্যসূচির পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন এভাবে:-

১. পরমাণু সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সম্পর্কে ভারতের মাটিতে অনুসন্ধান চালানো;

২. প্রাপ্ত খনিজপদার্থগুলোর পরিশোধনের জন্য কয়েকটি কারখানায় স্থাপন করা;

৩. গবেষণার প্রয়োজনে কয়েকটি পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর তৈরি করা;

৪. মৌলিক গবেষণা চালানো।

১৯৫২ সালের আগেই ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের পারমাণবিক খনিজ শাখার উদ্যোগে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায় বিহারের জাদুগুড় ও কেরালার গালওয়ে অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মোলজাইট এবং নাথিয়াম সঞ্চিত আছে।
১৯৫৪ সালে ভাবার উদ্যোগে বোম্বাইয়ের ট্রম্বেতে স্থাপিত হলো একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র।

ভাবা নিজেই হলেন এর পরিচালক। ভাবা ইতিমধ্যে টাটা ইনস্টিটিউটে অনেক পারমাণবিক কর্মী তৈরি করেছিলেন। তিনি তাদেরকেই এই সরকারি নতুন প্রকল্পে কাজে লাগালেন।এর আগের বছরেই ১৯৫৩ সালে বোম্বাইয়ের ট্রম্বেতেই স্থাপিত হয় থোরিয়াম প্ল্যান্ট এটিও ভাবার উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানেই স্থপিত হয়।

১৯৫৫ সালে ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই বছরেই কলম্বো প্ল্যান অনুসারে ট্রম্বেতে ভারত-কানাডা যৌথভাবে একটি বড় আকারের রিঅ্যাক্টর তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *