জীবনী: লুই পাস্তুর

লুই পাস্তুর

জীবনী: লুই পাস্তুর 

প্যারিসের এক চার্চে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। কন্যা পক্ষের সকলে কনেকে নিয়ে আগেই উপস্থিত হয়েছে। পাত্র পক্ষের অনেকেই উপস্থিত। শুধু বর এখনো এসে পৌঁছায়নি। সকলেই অধীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে কখন বর আসবে। কিন্তু বরের দেখা নেই।

চার্চের পাদ্রীও অধৈর্য হয়ে ওঠে। কনের বাবা পাত্রের এক বন্ধুকে ডেকে বললেন, কি ব্যাপারে, এখনো তো তোমার বন্ধু এল না? পথে কোন বিপদ হল না তো? বন্ধু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। দু-চার জায়গায় খোঁজ করল কিন্তু কোথাও বরের দেখা নেই। হঠাৎ মনে হলো একবার ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খোঁজ করলে হত। যা কাজপাগল মানুষ, বিয়ের কথা হয়ত একেবারেই ভুলে গিয়েছে।

ল্যাবরেটরিতে গিয়ে হাজির হলো বন্ধু। যা অনুমান করেছিল তাই সত্যি। টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে আপন মনে কাজ করে চলেছে বর। চারপাশের কোন কিছুর প্রতিই তার দৃষ্টি নেই। এমনকি বন্ধুর পায়ের শব্দ তার তন্ময়তা ভাঙ্গে না। আর সহ্য করতে পারে না বন্ধ, রাগেতে চেঁচিয়ে ওঠে, আজ তোর বিয়ে, সবাই চার্চে অপেক্ষা করছে আর তুই এখানে কাজ করছিস!

মানুষটা বন্ধুর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, বিয়ের কথা আমার মনে আছে কিন্তু কাজটা শেষ না করে কি করে বিয়ের আসরে যাই। বিজ্ঞানের গবেষণায় উৎসর্গীকৃত এই মানুষটির নাম লুই পাস্তুর। ১৮২২ সালের ক্রিসমাস পর্বের দুদিন পর ফ্রান্সের এক ক্ষুদ্র গ্রাম জেলেতে পাস্তুর জন্মগ্রহণ করেন। বাবার প্রথম জীবনের নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীতে সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতেন।

ওয়ার্টর্লুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর যোসেফ পাস্তুর গ্রামে ফিরে এসে ট্যানারির কাজে যুক্ত হন। অল্প কিছুদিন পরেই স্বগ্রাম পরিত্যাগ করে আরবয় নামে এক গ্রামে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন। এখানেই ট্যানারির (চামড়া তৈরির কাজ) কারখানা খুললেন। যোসেফ কোনদিনই তার পুত্র লুইকে ট্যানারির ব্যবসায়ে যুক্ত করতে চাননি।

তার ইচ্ছা ছিল পুত্র উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করুক। কয়েক বছর স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করবার পর যোসেফ পুত্রকে পাঠালেন প্যারিসের এক স্কুলে। গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা লুই প্যারিসের পরিবেশ কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। শহরের দমবন্ধ পরিবেশ অসহ্য হয়ে উঠত তার কাছে। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এই সময় একটা চিঠিতে লিখেছেন, ‍“যদি আবার বুক ভরে চামড়ার গন্ধ নিতে পারতাম, কয়েক দিনেই আমি সুস্থ হয়ে উঠতাম।”

অল্প কয়েক মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে শহরের নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন লুই। তার গভীর মেধা অধ্যাবসায় পরিশ্রম শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়াল না। এরপর তিনি ভর্তি হলেন রয়েল কলেজ। সেখান থেকে ১৮ বছর বয়সে স্নাতক হলেন। এই সময় নিজের কলেজেই তিনি একদিন শিক্ষকতার কাজ শুরু করলেন, অন্যদিকে বিজ্ঞানে ডিগ্রী নেবার জন্য পড়াশোনা করতে থাকেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক হলেন।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পাস্তুরের প্রিয় বিষয় ছিল রসায়ন। রসায়নের উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে আরম্ভ করলেন। দুই বছর পর লুই পাস্তুর স্টাপবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য ডাক পেলেন। আনন্দের সঙ্গে এই পথ গ্রহণ করলেন পাস্তুর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ছিলেন মসিঁয়ে লরেন্ট। তার গৃহে নিয়মিত যাতায়াত করতে করতে রেক্টরের ছোট মেয়ে মেরির প্রেমে পড়ে যান।

কয়েক সপ্তাহ পরেই রেক্টরের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন পাস্তুর। মসিঁয়ে লরেন্টও অনুভব করেছিলেন পাস্তুরের প্রতিভা। তাই এই বিয়েতে তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন। কিন্তু বিজ্ঞান তপস্বী লুই পাস্তুর বিয়ের দিনেই বিয়ের কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। এই মিলন পাস্তুরের জীবনকে সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিল।স্ত্রী মেরি ছিল পাস্তুরের যোগ্য সহচরী। স্বামীর সর্ব কাজে আজীবন তিনি সাহায্য করে গিয়েছেন।



একবার ফ্রান্সের যুবরাজ স্টাপবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে এলেন, সেই উপলক্ষে বিরাট আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষকরাই তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে সেই আনন্দ উৎসবে যোগদান করল। শুধু পাস্তুর তার গবেষণাগারে আপন কাজে এত আত্মমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন, ভুলেই গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের কথা।

সন্ধ্যেবেলায় যখন নিজের গৃহে ফিরে এলেন পাস্তুর সমস্ত দিনের আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি বলে একটিবারের জন্য অনুযোগ করলেন না মেরি। স্বামীর সাধনায় নিজেকেও উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। তাই পরবর্তীকালে পাস্তুরের এক ছাত্র বলেছিল, তিনি শুধু পাস্তুরের স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন তার যোগ্য সহচরী।

১৮৫৪ সালে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে পাস্তুরকে লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হল। লিলের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য মদ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছিল। এই মদ থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হত। কিছুদিন যাবৎ সকলেই লক্ষ্য করছিল কারখানায় প্রস্তুত মদের একটা বিরাট অংশ সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে গ্যাঁজ হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।

এতে শুধু কারখানার মালিক নয়, সরকারেও ক্ষতি হচ্ছিল। এর কারণ অনুসন্ধানের ভার দেওয়া হল পাস্তুরের উপর। একদিন তিনি একটা মদের কারখানায় গেলে। সেখানে বড় বড় চৌবাচ্চায় মদ ঢালা হত। একদিকে থাকত ভালো মদ অন্যদিকে খারাপ মদ। দুই মদের নমুনা এনে পরীক্ষা করলেন পাস্তুর। দীর্ঘ পরীক্ষার পর লক্ষ্য করলেন, ভালো মদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র গোল এক ধরনের পদার্থ রয়েছে (globules of Yeast nearly spherical) এবং খারাপ মদের মধ্যে লম্বা ধরনের ক্ষুদ্র পদার্থ রয়েছে (elongated)।

পাস্তুর সিদ্ধান্তে এলেন কোন পারিপার্শ্বিক প্রভাবে গোলাকৃতি পদার্থটি লম্বা আকার ধারণ করছে আর তারই ফলে ভালো মদে গ্যঁজ সৃষ্টি হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছ। শুরু হল তার গবেষণা। দীর্ঘ ১০ বছর সাধনার পর তিনি সিদ্ধান্তে এলেন বাতাসের মধ্যে রয়েছে অদৃশ্য জীবাণুর দল যারা ভাল মদের সঙ্গে সংস্পর্শে এসে তার মধ্যে পচন সৃষ্টি করছে।

এতদিন ধারণা ছিল এই সমস্ত জীবাণুর জন্ম আপনা থেকে কিংবা কোন অজৈব পদার্থ থেকে হয়। এই প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গে তিনি জন্ম দিলেন এক নতুন ধারণার। পাস্তুর শুধু মদ বিনষ্টের কারণ যে ব্যক্টিরিয়া বা জীবাণু (Bactria) তার স্বরূপ উদঘাটন করে ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন কিভাবে মদের গুণগত মানের পরিবর্তন না করে তার ক্ষতিকর ব্যক্টিরিয়াকে ধ্বংস করা যায়।

তিনি মদকে বিভিন্ন উত্তাপে গরম করতে আরম্ভ করলেন। অবশেষে লক্ষ্য করলেন ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটেডে বা ১৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইট উত্তাপে মদের কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যক্টিরিয়া ধ্বংস হয়। তার এই আবিষ্কৃত তথ্য আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে পাস্তুরাইজেসন (Pasteuri-zation) নামে পরিচিত। বর্তমানে এই পদ্ধতিতে শুধু যে মদ সংরক্ষণ করা হয় তাই নয় এতে নানান ধরনের খাবার পানীয় দুধ ক্রীম সংরক্ষণ করা হয়।

যার সুফল আমরা সকলেই ভোগ করছি। কিন্তু অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই জানে এই সমস্ত পাস্তুরের অবদান। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজে লাগালেন লর্ড লিস্টার (Lord Lister) আগে যে কোনো ক্ষতই সহজে দূষিত হয়ে যেত। তিনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন যাতে বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণুরা কত স্থানে প্রবেশ করতে না পারে।

এই সময় ফরাসি দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল রেশম শিল্প। কিন্তু এক অজানা রোগে হাজার হাজার গুটি পোকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞানীরা অনেক অনুসন্ধান করেও সেই রোগের কারণ, তার প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিরূপণ করতে পারছিলেন না। অবশেষে ফরাসি সরকার এই কাজের দায়িত্ব দিলেন পাস্তুরের উপর।

দীর্ঘ তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি আবিষ্কার করলেন অসুখ এবং সেই অসুখ নির্মূল করার উপায়। এই গবেষণার কাজে অমানুষিক পরিশ্রমের জন্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই সময় প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা কাজ করতেন। তার সর্বশরীর প্রায় অবশ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা তার জীবনের আশা ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু প্রবল মানসিক শক্তির সাহয্যে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি চিন্তা করতেন উন্নত গুটি পোকা সৃষ্টির উপায় যাতে আরো বেশি রেশম উৎপাদন করা যায়।



যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে। বিভিন্ন শ্রেনির সকল বিষয়ে সাজেশন পেতে এখানে ক্লিক করুন। নতুন নতুন সব শিক্ষামূলক ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।

বি: দ্র: তোমার নিজের রচিত কবিতা, সাহিত্য বা যেকোনো শিক্ষামূলক লেখা পাঠিয়ে দাও এডুয়েটিক’র কাছে। এডুয়েটিক প্রকাশ করবে তোমার প্রিয় লেখাটি।

Leave a Comment